13 February 2010

ছাত্রলীগ করাই ছিল তাঁদের অপরাধ!




নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১৩-০২-২০১০


‘কোনো দিন আর ছাত্রলীগ করবি? যদি করিস তা হলে জবাই করে ফেলব।’ প্রশ্নগুলো ফিরোজকে করা হলেও উত্তরের অপেক্ষা করেনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের ঘাতকেরা। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তারা কেটে ফেলে ফিরোজের দুই পায়ের রগ আর বাঁ হাতের সব আঙুল। অন্যদিকে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে তারা হবিবুর রহমান হল থেকে নামিয়ে আনে বাদশা, সোহাগ ও শামীমকে। শিবিরের ধাওয়া খেয়ে শামীম পালাতে পারলেও আহত হন সোহাগ। আর বাদশাকে জিয়া হলের পেছনে নিয়ে ধারালো অস্ত্রের উপর্যুপরি আঘাতে দুই পায়ের রগ আর হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে ঘাতকের দল।

ফিরোজ মো. আরিফুজ্জামান: জানুয়ারির ২০ তারিখে শেষ সম্বল জমি বন্ধক দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফিরোজের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন পল্লি চিকিত্সক বাবা মো. হারুন রশীদ। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ফিরোজ মো. আরিফুজ্জামানের সেমিস্টার পরীক্ষা ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি। আর মাত্র কয়েক দিন পরই ফিরোজ পাস করেবেন, চাকরি পাবেন, সংসারে সচ্ছলতা আসবে—এই স্বপ্নে বিভোর ছিল ফিরোজের পুরো পরিবার। আর এখন পরিবারের সব সদস্য দিশেহারা।

ফিরোজের বরাত দিয়ে হাসপাতালে তাঁর বাবা প্রথম আলোকে জানান, ঘটনার দিন বিনোদপুরের নিরিবিলি ছাত্রাবাসের নিজ কক্ষে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ফিরোজ। রাত সোয়া ১২টায় হঠাত্ অচেনা একজন কক্ষে ঢুকে ফিরোজকে বলে, ‘প্রশাসনের লোকজন তোমাকে ডাকছে।’ বাইরে বের হলেই ছয়-সাতজনের একটি দল তাঁকে নিয়ে যায় বেতার মাঠে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত করে ফিরোজকে ফেলে রেখে যায় তারা। গলায় অস্ত্রের আঘাত ঠেকানোর জন্য ফিরোজ বাঁ হাতে বাধা দেওয়ায় কেটে যায় তাঁর সব কটি আঙুল। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ডান হাতে মোবাইল ফোন বের করে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ হোসেনকে ফোন করেন ফিরোজ। সেখানে কোনো উত্তর না পেলে ফোন করেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু তোফাজ্জলকে। তোফাজ্জল দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসেন এবং ফিরোজকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

সাইফুর রহমান বাদশা: সংসারের সবচেয়ে ছোট আর আদরের সন্তান বাদশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। শহীদ হবিবুর রহমান হলের ৩৪১ রুমে থাকতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন বাবা আবদুল করিম। ছোট ছেলের পড়াশোনা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন তিনি। চার ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাইসহ দুই বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট ভাই স্নাতকোত্তর শেষে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসক হবে, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; না হলেও কমপক্ষে কলেজের প্রভাষক হবে—এ আশা ছিল সবার। এখন বাবা-মা ও বোনদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। বাদশার পঙ্গু জীবনের আশঙ্কায় আতঙ্কিত সবাই।

বাদশার বরাত দিয়ে হাসপাতালে তাঁর বড় ভাই রাজিউর রহমান রাজা জানান, ঘটনার দিন রাত আটটায় ছাত্রশিবিরের হাতে কাউসার ও আসাদ মার খাওয়ায় পুরো ক্যাম্পাসে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। রাত ১২টা পর্যন্ত সতর্ক থাকার পর প্রশাসনের অনুরোধে হলে ফিরে ঘুমাতে যান সবাই। এমন সময় শিবিরের কর্মীরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসে ঢোকে। স্বাভাবিকভাবে মিছিলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেমে আসেন বাদশা, শামীম ও সোহাগ। নিচে নামতেই ধারালো অস্ত্রের বাড়ি খেয়ে ড্রেনে পড়ে যান সোহাগ। দৌড়ে জিয়া হলে পালিয়ে যান শামীম। কিন্তু বাদশার ঘাড়ে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে টেনেহিঁচড়ে জিয়া হলের পেছনে নিয়ে যায় শিবিরের কর্মীরা। তাঁর হাতের কবজি প্রায় অর্ধেক কেটে ফেলে শিবিরের কর্মীরা। দুই হাতই প্রায় কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা। কেটে দিয়েছে দুই পায়ের রগ। গুরুতর জখম প্রায় অচেতন বাদশা অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে নিজ হলের সামনে আসেন। তখন সহপাঠীদের সহযোগিতায় তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়।

গতকাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের দোতলায় কেবিন ব্লকে পাশাপাশি দুই বিছানায় শুয়ে আছেন ফিরোজ ও বাদশা। পাশে রয়েছে তাঁদের আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা। রাজশাহী ও পঙ্গু হাসপাতালে দুজনেরই এখন পর্যন্ত চার দফা অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিত্সকেরা জানান, এক মাস পর্যবেক্ষণ শেষে বলা যাবে, তঁদের হাত-পা কতটুকু ভালো হবে।

কান্না-জড়ানো গলায় ফিরোজের বাবা হারুনুর রশীদ ও বাদশার ভাই শিবির কর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস: বাদশা-ফিরোজের যাবতীয় চিকিত্সার খরচ সরকার বহন করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। প্রয়োজনে উন্নত চিকিত্সার জন্যে তাঁদের বিদেশে পাঠানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) বাদশা-ফিরোজকে দেখতে গিয়ে এ আশ্বাস দেন তিনি। এ সময় ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদ হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন