নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১৩-০২-২০১০
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে—ইসলামী ছাত্রশিবিরের এমন নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে দেশব্যাপী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ-র্যাব। গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো যৌথ অভিযানে ১৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বেশির ভাগকেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ছাত্রশিবিরের কর্মীরা দেশের অনেক স্থানে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালাতে গোপন বৈঠক করছে বলে খবর রয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু সিডি ও কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। ঢাকায় শিবির কর্মীদের গ্রেপ্তারের সময় তাদের আবাসস্থল থেকে ৭৪ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নামের একটি তালিকা পাওয়া গেছে।
৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হওয়ার পর ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহীর ঘটনার পর যাতে আর কোথাও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে না পারে, সে জন্য সন্দেহভাজনদের আটক করা হচ্ছে। এ অভিযান চলবে বলে জানান তিনি।
পুলিশ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাতের অভিযানে রাজধানী ঢাকার তিনটি থানা থেকে ৫৭ জন এবং চট্টগ্রামে সংঘর্ষের সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৮৬ জনকে। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আহসান উল্লাহও রয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহী মহানগর ও বাগমারায় নয়জন, বরিশালে দুজন, পাবনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এ ব্যাপারে গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, পুলিশ জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে জামায়াত ও শিবিরের অফিস, মেস, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর করছে। এভাবে তারা দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজশাহী মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির আতাউর রহমানকে রিমান্ডে নেওয়ারও প্রতিবাদ করেন মুজাহিদ।
রাজধানীতে অভিযান: ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের পেছনের একটি মেস থেকে শিবিরের ২১ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ১৯ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গ্রেপ্তারের পর গতকাল তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ জানায়, শিবিরের এই কর্মীদের কাছ থেকে ছাত্রলীগের ৭৪ নেতা-কর্মীর নামের তালিকা উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, শিবির তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর পরিকল্পনা করেছিল।
পুলিশ জানায়, উত্তরার পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে ছাত্রশিবিরের ৩১ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম প্রথম আলোকে জানান, বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেছনের একটি মেসে গোপন বৈঠক করার সময় শিবিরের ২১ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এখানে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন: শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রচার সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের ছাত্র মহব্বত আলী, অর্থ সম্পাদক ও ইসলামিক শিক্ষা বিভাগের ছাত্র আবুল কাশেম, প্রকাশনা সম্পাদক ও ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র জামাল উদ্দিন, হাফিজুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মোহাম্মদ হাবিব, গণিত বিভাগের নাইমুল ইসলাম, অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সাখাওয়াত হোসেন, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের হাদিয়ার রহমান, লোকপ্রশাসনের শফিউল্লাহ খান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আব্দুল গফুর, ইংরেজির ময়েনউদ্দিন, ফলিত রসায়নের মো. কবির ও এহতেশামুল হক, সমাজবিজ্ঞানের ইনসানাল, মুনতাসীর মামুন ও আতিকুল ইসলাম, প্রাণিবিদ্যার আমিনুল ইসলাম, আরবির ইব্রাহিম খলিল ও উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের মাসুদ রানা। অন্য দুজন হলেন: ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. সাব্বির ও আইবিআইটির আলমগীর হোসেন।
উত্তরা অঞ্চলের উপপুলিশ কমিশনার নিসারুল আরিফ প্রথম আলোকে জানান, রাজশাহীতে ছাত্রলীগের এক কর্মী নিহত হওয়ার পর সেখানকার শিবিরের অনেক নেতা-কর্মী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে এসেছে, এমন তথ্য পাওয়ার পর অভিযান শুরু করা হয়।
উত্তরার পুলিশ জানায়, সেখানকার মেস থেকে যে ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে সরকারবিরোধী ও জিহাদি বই-প্রচারপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
উত্তরা থানার ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান প্রথম আলোকে জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তাদের কাছ থেকে রক্তমাখা বইসহ আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অনেক বই পাওয়া গেছে। মতিঝিল থানার পুলিশ অপর এক অভিযানে পাঁচ শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।
চট্টগ্রামে ৮৬ জন গ্রেপ্তার: নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত ছাত্র এ এ এম মহিউদ্দিনকে দলীয় কর্মী দাবি করে ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগ গতকাল শুক্রবার দুপুরে আলাদাভাবে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে। দুপুরে জামালখান এলাকায় শিবিরের মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৯৬ জনকে আটক করে। পরে যাচাই-বাছাই করে কমবয়সী, পরীক্ষার্থী ও পথচারী ১০ জনকে ছেড়ে দিয়ে ৮৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, পুলিশের ওপর হামলা, বিস্ফোরক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। এ ব্যাপারে গতকাল একটি নিয়মিত মামলা (নম্বর-২৩) হয়েছে।
বরিশাল অফিস জানায়, গতকাল সকালে নগরের কাটপট্টি এলাকা থেকে দুই শিবির কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁরা হলেন: হারুন অর রশিদ ও সাইফুল ইসলাম। গতকাল তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরিশালে ছাত্রশিবির সংগঠিত হয়ে নগরের ফলপট্টি এলাকা থেকে মিছিল বের করে। এ সময় পুলিশ তাদের মিছিল করার কোনো অনুমতি না থাকায় তাতে বাধা দেয়। পুলিশের বাধা অতিক্রম করে মিছিল করতে চাইলে পুলিশ সেখান থেকে দুজন শিবির কর্মীকে পুলিশ আটক করে।
পাবনা অফিস জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি শিবির কর্মী রমজান আলীকে পুলিশ পাবনা সদর উপজেলার ফরিদপুর গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে।
বাগমারা (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, ফারুক হত্যা মামলার আসামি শিবির কর্মী আব্দুল ওহাব, আব্দুস সালাম ও জিয়াকে র্যাব তাঁদের গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে।
রাজশাহী অফিস জানায়, র্যাব ও পুলিশ রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছয় শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া নওগাঁ এলাকা থেকে শিবির ক্যাডার মারুফকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন। পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্রশিবিরের হামলায় তিনি মারা যান। এর পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন