একরামুল হক ও মাইনউদ্দিন হাসান, চকরিয়া (কক্সবাজার) থেকে | তারিখ: ১৩-০২-২০১০
চার সন্তানের পড়াশোনার খরচের জোগান দিতে গিয়ে রাজারবিল গ্রামের ছোট মাটির ভিটার জরাজীর্ণ ঘরটি সংস্কার পর্যন্ত করতে পারেননি ফজলুল কাদের। ২০০২ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার (বিএডিসি) ভান্ডাররক্ষকের চাকরি হারান তিনি। অন্ধকার নেমে আসে সংসারে। তিন হাজার টাকা বেতনে বেসরকারি পরিবহন কোম্পানির টিকিট বিক্রির চাকরি নেন। তিন লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছে সন্তানদের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ জোগাতে।

মহিউদ্দিনের শোকার্ত মা-বাবাঃ ছবি: প্রথম আলো
এসব এখন বারবার মনে আসছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত ছাত্র এ এ এম মহিউদ্দিনের বাবার। রাজনীতি বিজ্ঞানের এমএর ছাত্র ছিলেন মহিউদ্দিন। বড় ছেলেকে হারিয়ে কেবল বিলাপ করছিলেন মা হাছিনা আক্তার। ‘২০০২ সালের ১ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামী (তখনকার কৃষিমন্ত্রী) আমার স্বামীসহ এক হাজার ১০০ লোককে চাকরিচ্যুত করেন। হঠাত্ চাকরি চলে যাওয়ায় সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে পাঁচ বছর পরিবহন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। আমার মানিকও (মহিউদ্দিন) এসএসসি পাস করার পর টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাত।’
আবার বিলাপ শুরু করেন মা, ‘ও আঁর মানিক, তুই হোডে গিলিগই...। ও আল্লাহ আঁর পোয়ার কী দোষ গজ্জিলদে। কিয়েরলাই আঁর পোয়ারে মারি ফালাইয়েদে...।’ প্রতিবেশীরাও চোখের পানি আটকে রাখতে পারছিল না। গুমোট হয়ে উঠেছিল কক্সবাজারের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালীর রাজারবিল গ্রামের নোয়াপাড়ার পরিবেশ।
মা-বাবার বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরার কথা তো মহিউদ্দিনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ভালো একটা চাকরি, ছোট ভাইবোনদের গড়ে তোলার—সব স্বপ্ন নিয়ে গতকাল বিকেলে মহিউদ্দিন আলো-বাতাসের বাইরে চলে গেলেন। তাঁর দাফন যেন একটি পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার দাফন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে ছেলের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন বাবা ফজলুল কাদের। মহিউদ্দিনকে একনজর দেখতে গ্রাম ও আশপাশের এলাকার কয়েক হাজার নারী-পুরুষ বাড়ির সামনে, আঙিনায় অপেক্ষা করছিল। বাড়ির উঠোনে তাঁর লাশ নামাতেই ওঠে কান্নার রোল। নিজেদের সংযত রাখতে পারেননি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে আসা পুলিশ সদস্যরাও।
আদরের সন্তানের নিথর দেহের পাশে বসে বিলাপ করছিলেন ফজলুল কাদের, ‘আমি আর আমার সন্তানেরা জীবনে কারোর ক্ষতি করিনি। আমি না খেয়ে, না পরে ছেলেদের মানুষ করার চেষ্টা করেছি। হে আল্লাহ, এই কোন কঠিন পরীক্ষায় আমি পড়েছি। এর কি কোনো বিচার হবে না?’
গতকাল বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় মহিউদ্দিনকে। এর আগে সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মহিউদ্দিনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। দুপুরে পুলিশ পাহারায় বাবা ও ভাই আবদুল্লাহ আল মামুনসহ আত্মীয়রা লাশ গ্রহণ করেন।
মহিউদ্দিনের মামা মো. আলমগীর জানান, ‘ভাগ্নেটাকে নিয়ে বোন ও দুলাভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। সন্ত্রাসীরা কেন তাঁকে মেরেছে, জানি না। তাঁর লাশ নিয়ে রাজনীতিও হচ্ছে।’ তিনি বলেন, মহিউদ্দিনের বাবা চাকরি হারানোর পর পরিবারের সবাই চারদলীয় জোট সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁদের সমর্থন ছিল। মহিউদ্দিন সক্রিয় রাজনীতি করতো না, তবে তিনি ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। ওর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, জামায়াত আবার ক্ষমতায় গেলে বাবা চাকরি ফিরে পাবেন না।’
পারিবারিক সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাসের পর মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম নৌবাহিনী কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবনে বেশির ভাগ সময় থেকেছেন চট্টগ্রাম শহরে ছোট খালার বাসায়। তখন থেকে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে টিউশনি করতেন মহিউদ্দিন।
২০০২ সালে বাবা চাকরি হারালে মহিউদ্দিনের ভাগ্যে ভালো শার্ট-প্যান্ট কম জুটেছে। ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট চাকরি ফিরে পান ফজলুল কাদের। পরিবারেও ধীরে ধীরে সচ্ছলতা ফিরে আসছিল।
কাঁদতে কাঁদতে মা হাছিনা আক্তার জানান, ‘২৯ জানুয়ারি মানিকের (মহিউদ্দিন) সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়। আমার বোনের দেওয়া কাপড় দিয়ে শার্ট বানিয়ে ওই দিন তাঁকে দিয়েছিলাম।’
খালাতো ভাই সাহাবউদ্দিন নিহত মহিউদ্দিনের জরাজীর্ণ ঘর দেখিয়ে বলেন, ‘আমার খালার ঘরটি আংশিক টিনের, আংশিক শণের। ভেতরে মাটির দেয়াল।’
মহিউদ্দিনের অন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন আইন বিষয়ে (সম্মান) পড়ছেন। ছোট ভাই আবদুল্লাহ আল ছগীর এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। একমাত্র বোন ফৌজিয়া ফারিয়া অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।
ছগীর গতকাল সারা দিন কেঁদেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার ভাইয়ার শত্রু থাকতে পারে, এটা বিশ্বাস হয় না। কেউ পরিকল্পিতভাবে ভাইয়াকে খুন করেছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহিউদ্দিনের এক নিকটাত্মীয় বলেন, ‘আলাওল হল ছেড়ে দিতে শিবির ক্যাডাররা তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন বলে শুনেছি। শিবিরের ওই ক্যাডারদের পুলিশ গ্রেপ্তার করলে তাঁর হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসবে।’
মহিউদ্দিনের আত্মীয়দের অভিযোগ, তাঁর হত্যাকাণ্ডে ছাত্রশিবির জড়িত। আলাওল হলে ওঠার পর থেকে শিবির ক্যাডাররা তাঁকে হুমকি দিচ্ছিলেন। ঘাতকেরা ক্যাম্পাসের পরিবর্তে ষোলশহর স্টেশনকে বেছে নেয় এবং পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করে। খুনিরা অন্ধকারে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেন, যাতে কোনো সাক্ষী না থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার জেড এ মোরশেদ গত বুধবার ষোলশহরে মহিউদ্দিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শিবির জড়িত থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন।
দাফন: গতকাল বিকেল পারিবারিক কবরস্থানে মহিউদ্দিনের লাশ দাফনের সময় সংরক্ষিত মহিলা আসনের আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ সাফিয়া খাতুন, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ, চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, পৌরসভার মেয়র জাফর আলম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন