15 February 2010

জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প!

রফিকুল ইসলাম ও এস এম মঈনুল, বরিশাল

বরিশাল নগরীর হেমায়েত উদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় জামে কসাই মসজিদকে পাকিস্তান আমল থেকেই জেলা জামায়াতের (পশ্চিম ও পূর্ব) অলিখিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মসজিদের তৃতীয় তলার কয়েকটি কক্ষে চলে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। মসজিদ কমপ্লেক্সকে জামায়াতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনের নেতারাও জানেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদের তৃতীয় তলার উত্তর দিকের ১০ ও ১১ নম্বর কক্ষের মাঝের দেয়াল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে মিলনায়তন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরের ১২ নম্বর কক্ষটি ব্যবহার করা হয় গেস্টহাউস হিসেবে। ১৫ ও ১৭ নম্বর কক্ষ ব্যবহার করা হয় জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক রিপোর্টিং কক্ষ হিসেবে। ২১ নম্বর কক্ষটি ব্যবহার করা হয় ডাইনিং রুম হিসেবে। প্রশিক্ষণের সময় বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতা-কর্মীদের খাবারের আয়োজন করা হয় এখানে। এ ছাড়া তৃতীয় তলার কয়েকটি কক্ষে জামায়াত-শিবির কর্মীরা বসবাস করেন।

মসজিদের খাদেম ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ছাড়া ১১ ও ১২ নম্বর কক্ষ দুটির দরজা সাধারণত খোলা হয় না।

মসজিদের খাদেম খলিলুর রহমান বলেন, 'স্বাধীনতার আগে থেকেই দেখছি, কেন্দ্রীয় জামে কসাই মসজিদটি জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'চারদলীয় জোট সরকারের সময় এখানে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তেমন আসত না। কিন্তু জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে প্রতিদিন কম করে হলেও অর্ধশত নেতা-কর্মী ওই কক্ষে আলোচনায় বসত। আসর থেকে শুরু করে মাগরিব পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে একেকটি গ্রুপ আলোচনা করত।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মসজিদের এক খাদেম বলেন, এক সময় বরিশাল জেলার (পশ্চিম) সাবেক আমির নূর মোহাম্মদ মিয়ার নামে ১২ নম্বর কক্ষটি বরাদ্দ ছিল। তিনি প্রায়ই ওই কক্ষে দলীয় আলোচনা শেষে রাত যাপন করতেন। অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা সাংগঠনিক আলোচনা করতেন।

নগরীর দক্ষিণ চকবাজারের ব্যবসায়ী মামুন হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, জুমার নামাজ শেষে জামায়াত ও শিবিরের লোকজন তৃতীয় তলার ১৭ নম্বর কক্ষে গিয়ে আলোচনা করে।

মসজিদটির ইমাম মাওলানা কাজী আবদুল মান্নান বলেন, মসজিদের তৃতীয় তলার একাধিক কক্ষ ভাড়া নিয়ে জামায়াতে ইসালামী তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। জেলা জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা প্রতিদিন আসরের পর থেকে শুরু করে এশার নামাজের আগ পর্যন্ত ওই কক্ষগুলোতে অবস্থান করে থাকেন। ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাও তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, 'জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ঊর্ধ্বতন নেতাদের কাছে কোরআন শরিফের আয়াত পাঠ করে শোনান, যাকে সংগঠনের ভাষায় তালিমুল কোরআন বিভাগের রিপোর্ট বলা হয়। ওই অনুষ্ঠানে জেলা জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অংশ নেন।' বিষয়টি অনেক আগেই মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে জানানো হয়েছিল বলে তিনি জানান।

জেলা জামায়াতের (পূর্ব) আমির আবদুল জব্বার বলেন, 'স্বাধীনতার পর থেকেই জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা ওই মসজিদে নামাজ শেষে কোরআন নিয়ে আলোচনা করে আসছে। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা আর রাজনীতি এক নয়।' তিনি বলেন, 'সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তালিমুল কোরআন রিপোর্ট করেন আমাদের কাছে। এটা রাজনীতির বিষয় নয়।'

স্টিমারঘাট জামে মসজিদের খতিব মাওলানা শরফ উদ্দিন বেগ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মসজিদ পবিত্র স্থান। এখানে এমন কোনো কর্মকাণ্ড চালানো উচিত নয়, যেটা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।'

বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, 'মসজিদে দলীয় কার্যক্রম চলছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।'

জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, 'শুধু বরিশাল নয়, জামায়াত-শিবির দেশের অধিকাংশ মাদ্রাসা ও মসজিদকে তাদের অলিখিত কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্মের কথা বলে এরাই ধর্মকে বিক্রি করছে।'

জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. মোখলেছুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাকিস্তান আমল থেকে জামায়াত কসাই মসজিদকে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।'

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান সরোয়ার বলেন, 'স্বাধীনতার পর থেকেই শুনে আসছি, জামে কসাই মসজিদে জামায়াতের দলীয় কর্মকাণ্ড চলছে। এ বিষয়টি সত্য হলে, আমি এর বিরোধিতা করছি। একই সঙ্গে তাদের মসজিদকেন্দ্রিক রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করছি। রাজনীতি করতে গিয়ে তারা যেন মসজিদ ব্যবহার না করে।'

এ ব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, বরিশালে জামায়াতের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড জামে কসাই মসজিদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে আসছে। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবহিত আছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় তাঁরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন