15 February 2010

৫৪ ক্যাডার ধরতে সারা দেশে জরুরি বার্তাঃ ফারুক হত্যায় নেতৃত্ব দেয় দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার জাফর বাবু

আনু মোস্তফা, রাজশাহী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে শিবিরের হত্যা ও রগকাটা মিশনে নেতৃত্ব দেয় শিবির ক্যাডার আলী জাফর বাবু ওরফে জাফর বাবু। শিবিরের গ্রেপ্তার হওয়া ক্যাডাররা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এ তথ্য দিয়েছে। এদিকে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতের নৃশংসতায় অংশ নিয়েছিল এমন ৫৪ জন পলাতক শিবির ক্যাডারের তালিকা করেছে পুলিশ। শনিবার রাতে তালিকা চূড়ান্ত করা হয় এবং বিস্তারিত নাম-ঠিকানাসহ গতকাল রবিবার সারা দেশে বার্তা পাঠানো হয়।

সহিংসতা ও দুর্ধর্ষতার কারণে ১৯৯১ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির বাবুকে বহিরাগত ক্যাডার হিসেবে রিক্রুট করে। সেই থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সহিংসতায় শিবিরের পক্ষে অংশ নিয়ে
আসছে জাফর বাবু ও তার ক্যাডার বাহিনী। রাজশাহী মহানগর পুলিশের খাতায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত জাফর বাবুর চাঁদাবাজির টাকার ভাগও যায় শিবিরের তহবিলে।

গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রমতে, জাফর বাবু শিবিরের অন্য ক্যাডারদের অস্ত্র প্রশিক্ষণও দিয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। '৯২-পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে অস্ত্রসমৃদ্ধ করার কাজটিও জাফর বাবুই করে। শিবিরের হয়ে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির ফলে শিবিরে তার ভালো কদর রয়েছে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার নওশের আলী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া শিবির ক্যাডাররা রিমান্ডে বলেছে যে ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন হত্যাসহ এসএম হলের রগকাটা মিশনে জাফর বাবুই নেতৃত্ব দিয়েছে। আরএমপি রাজশাহী মহানগরসহ দেশের সব থানায় জাফর বাবুকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ পাঠিয়েছে। তিনি আরো জানান, ফারুক হত্যা মামলায় জাফর বাবুর নাম না থাকলেও তাকে আসামি করা হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ওই রাতে জাফর বাবুর নেতৃত্বে তিনটি দল ক্যাম্পাসে ঢোকে বধ্যভূমি এলাকা দিয়ে। মিশন শেষে ফেরেও একই পথে। সূত্র জানায়, ক্যাম্পাসে শিবিরের হাতে যেসব ছাত্র নিহত হয়েছে, সেসব কিলিং মিশনে সব সময়ই জাফর বাবু থেকেছে। তার সাহস ও নির্মমতার কারণে সে শিবিরের কিলিং মিশনে জায়গা পেয়েছে সব সময়।

জাফর বাবু ২০০৬ সাল থেকে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। ২০০৪ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যাসহ শিবিরের হয়ে তাণ্ডব চালানোর বিভিন্ন ঘটনায় মতিহার ও বোয়ালিয়া থানায় আটটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি অস্ত্র ও দুটি হত্যা মামলা। অন্যগুলো সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির। তবে তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশ বরাবরই নির্বিকার বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, জাফর বাবু নিয়মিত মাদক গ্রহণসহ মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে। হাল আমলে মতিহার থানা এলাকার ঘাটগুলো দিয়ে ফেনসিডিলের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে সে। শিবিরের হয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি করেছে। এসব চাঁদার টাকা শিবিরের তহবিলেও গেছে।

সূত্র জানায়, গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে নতুন কোনো মামলা হয়নি। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না হলেও জরুরি অবস্থার মধ্যে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছে র‌্যাবের হাতে। তবে কিছুদিনের মধ্যে সে ছাড়া পেয়ে যায়।

জাফর বাবুর মামলাগুলোর সর্বশেষ কী অবস্থা তা তাৎক্ষণিক জানাতে পারেননি মতিহার থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন খান।

এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতের নৃশংসতায় অংশ নিয়েছিল এমন ৫৪ জন পলাতক শিবির ক্যাডারের একটি তালিকা করেছে পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তার করতে দেশের ৬৪ জেলাসহ বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়েছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ। গত শনিবার রাতে তালিকা চূড়ান্ত করা হয় এবং বিস্তারিত নাম-ঠিকানাসহ গতকাল বার্তা পাঠানো হয়।

মহানগর পুলিশ কমিশনার নওশের আলী জানান, গ্রেপ্তারকৃত শিবির ক্যাডারদের রিমান্ডে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব শিবির ক্যাডার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

একই সঙ্গে শিবিরের 'কিলিং মিশনে' সহযোগিতা করেছে এমন লোকের তালিকাও প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আরএমপির গোয়েন্দা বিভাগে সহকারী কমিশনার (এসি) তারিকুল ইসলাম বলেন, কিছু লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিবির ক্যাডারদের মদদ জোগায়। তাদেরও আইনের আওতায় আনতে শিগগির গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হবে।

এসি তারিকুল ইসলাম জানান, তালিকাভুক্ত শিবির ক্যাডারদের সবাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র এবং প্রত্যক্ষভাবে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের অনেককেই হামলার জন্য নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার শিবির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন মেসে রাখা হয়েছিল। তারাই এক ছাত্রকে হত্যা এবং ২০ ছাত্রকে কুপিয়ে ও রগ কেটে গুরুতর জখম করে।

রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, ৫৪ শিবির ক্যাডারের তালিকায় প্রথম নামটি হলো রাবি শাখা শিবির সভাপতি শামসুল আলম গোলাপের। বাড়ি গোদাগাড়ী উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামে। রাবি শাখা শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেনের নাম রয়েছে দুই নম্বরে। বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বালিনা গ্রামে।

তালিকার বাকি ৫২ ক্যাডার হলো রাজশাহীর পবা উপজেলার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সোহেল, বাঘার ছাতারী গ্রামের রায়হান ওরফে আবু রায়হান ও রাকিবুল ইসলাম ওরফে রাকিব, কুমিল্লা সদরের জোড়া পুষ্করিণী গ্রামের শাহ নেওয়াজ ইফতেখার আহমেদ ওরফে স্বচ্ছ, পাবনার সাঁথিয়ার চাহরপাবেরিয়া গ্রামের খোন্দকার ফরহাদ হোসেন ওরফে ফরহাদ আলম, রাঙামাটিয়া গ্রামের নূর মোহাম্মদ, ঈশ্বরদীর চরমিরকামারী মাদারীপাড়া গ্রামের সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়া, আটঘরিয়ার কলমনগর গ্রামের শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক আহম্মেদ, ফরিদপুর সদর এলাকার রমজান আলী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের রামচন্দ্রপুরহাট গ্রামের ইয়াসিন আলী, শিবগঞ্জের পনের রশিয়া গ্রামের রাকিবুল ইসলাম, চাঁদপুর গ্রামের শীষ মোহাম্মদ, ছত্রাজিতপুর এলাকার রাজীব আহম্মেদ ওরফে রাজু, রানীনগর চাঁদপুর গ্রামের শাহীন রেজা ওরফে শাহিন, গোমস্তাপুর থানার ছিনাইতলা গ্রামের ইকবাল হোসেন, নাটোরের ধনাইদহ গ্রামের জাহিদ হোসেন, কাওমকুলী এলাকার আব্দুল খালেক, আহম্মদপুরের পারভেজ রানা ওরফে পারভেজ আলম, লালপুরের চামটিয়া গ্রামের আনিসুর রহমান ওরফে আনিস, যশোরের অভয়নগরের মাগুরা গ্রামের আনোয়ার হোসেন, ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামের সুমন গাজী, পিরোজপুরের জিয়ানগর থানার ভবানীপুর গ্রামের নাজমুল হক, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ঝিকড়া গ্রামের আরাফাত হোসেন, পাবনার তাড়াশ থানার কমরাইল গ্রামের মোখলেস-উর রহমান, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরের বড়শালিখা গ্রামের ইকরাম, সাতক্ষীরা সদর থানার কাথান্দা গ্রামের জাহিদ, কলারোয়া থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আমিরুল ইসলাম, আশাশুনির কালিমাখালী গ্রামের ওসমান গনি, লক্ষ্মীপুর জেলার রায়গঞ্জের আকারকাটা গ্রামের ফরহাদ হোসেন, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের রিপন, খুলনার পাইকগাছার খুরিয়াগ্রামের রাসেল রানা, কুড়িগ্রামের উলিপুরের রামপ্রসাদ গ্রামের আবু নোমান ওরফে নোমানী, ঝিনাইদহের মহেশপুরের জলিলপুর গ্রামের মারুফ হোসেন, গাজীপুর সদর থানার কলোনি এলাকার মাসুম বিল্লাহ, নোয়াখালীর কবিরহাটের উপানদী লামচি গ্রামের শিহাব আহমেদ, রাজবাড়ী সদর থানার দেউকি গ্রামের রুহুল আমিন, বালিয়াকান্দি থানার সিকেরা এলাকার মাসুম বিল্লাহ, নড়াইলের লোহাগড়ার মেলান্দহ গ্রামের তৌহিদ হোসেন, বগুড়ার কাহালুর পালপাড়া গ্রামের ইউসুফ আলী, নন্দীগ্রামের আল্টামাগ্রাম এলাকার আবু সাঈদ, হাটধুমা এলাকার তরিকুল ইসলাম, নেত্রকোনা সদর থানার শরিফুজ্জামান, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানার হাটরাপাড়া গ্রামের মোজাহিদুল ইসলাম, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামের সাবি্বর হোসেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের লাহারদিহি গ্রামের মাসুদ রানা, টাঙ্গাইলের গোপালপুরের সৈয়দপুর গ্রামের মাজাহার ইসলাম, গাইবান্ধা সদর থানার পিয়ারাগাছা গ্রামের সামিউল হক ওরফে মিলন, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থানার গোগরা গ্রামের ফারুক হোসেন, রংপুরের গঙ্গাচড়ার চ্যাংমারী গ্রামের শামিমুজ্জামান ওরফে শামীম, নীলফামারীর জলঢাকার হুমায়ুন কবির এবং লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের মওজশখাতি গ্রামের মিজানুর রহমান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, এদের মধ্যে পাবনার রমজান, নাটোরের খালেক, দিনাজপুরের সাবি্বর ও পাবনার মোখলেস-উর-রহমানকে ইতিমধ্যে আটক করেছে ওই সব জেলার পুলিশ।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন