10 February 2010

শিবিরের জবাই রগ কাটার রাজনীতি শুরু চট্টগ্রামে

রফিকুল বাহার, চট্টগ্রাম


বর্বরোচিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য সর্বস্তরে নিন্দিত ছাত্র সংগঠন শিবিরের প্রতিষ্ঠা ১৯৭৭ সালে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিতর্কিত দল জামায়াতে ইসলামীর এই ছাত্র সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় জবাই করে হত্যার রাজনীতি শুরু করে চট্টগ্রাম থেকে। মূলত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারের জন্যই তারা এখানকার মেধাবী ছাত্র ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হত্যার কৌশল নেয়।

শিবিরের হত্যার রাজনীতির প্রথম শিকার চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেন। ১৯৮১ সালের মার্চে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাকে। এর তিন বছর পর চট্টগ্রাম কলেজের সোহ্রাওয়ার্দী হলের ১৫ নম্বর কক্ষে শিবিরেরকর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে।

শিবিরের নৃশংসতায় চট্টগ্রামে আরো যাঁরা প্রাণ হারান তাঁদের মধ্যে আছেন ছাত্রমৈত্রী নেতা ফারুক ও ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছা। এ ছাড়া শিবির ডান হাতের কবজি কেটে দেয় জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা আবদুল হামিদের। পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয় ছাত্রনেতা ফরিদের।

'ধর্মের নামে তারা যে রাজনীতি করছে সেটি কোনো মুসলমান করতে পারে না। সহপাঠীরা আমাকে খারাপ ভাবতে পারে, গুনাহগার হতে পারি আমি, কিন্তু কোনো মুসলমান বিনা কারণে আরেক মুসলমান ভাইয়ের হাত কেটে ফেলতে পারে না।' গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন শিবিরের নৃশংসতার শিকার হয়ে এক হাত হারানো আবদুল হামিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় ছাত্রসমাজের তৎকালীন সভাপতি আবদুল হামিদ বর্তমানে ব্যবসায়ী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক ভিপি নাজিমউদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে ২৯ বছর আগের তবারক হত্যাকাণ্ডের বীভৎস বিবরণ দেন। তিনি বলেন, 'কিরিচের এলোপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন পানি পানি করে কাতরাচ্ছিল তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়।' তবারকের সহপাঠী ও সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, সাক্ষীর অভাবে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কারণ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ভয়ে অনেকে সাক্ষ্য দেয়নি।

১৯৮৪ সালের ২৮ মে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা মহব্বত আলীর ছেলে শাহাদাত হোসেন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ ব্যবহারিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমাতে যান। তাঁর রুমমেটরা ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে নির্মমভাবে হত্যা করে। শাহাদাতের সহপাঠী ও বর্তমানে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আতিক জানান, শিবিরকর্মী হারুন রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে নতুন ছুরি কিনে এনেছিল শাহাদাতকে জবাই করার জন্য। এ কথা হারুন আদালতে স্বীকার করেছে। তার যাবজ্জীবন এবং আরেক আসামি ইউসুফের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে আপিল করে দুই বছর পর ইউসুফ খালাস পেয়ে যায়।

শাহাদাতের বড় ভাই নির্মাণ ঠিকাদার সাখাওয়াত হোসেন সাক্কু গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শাহাদাতের হত্যার পর আমরা যাতে মামলা না চালাই সে জন্য শিবিরের তরফ থেকে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।'

১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহ্রাওয়ার্দী হলের চত্বর থেকে ভাত খেয়ে রিকশাযোগে আলাওল হলে ফেরার সময় জঙ্গল থেকে প্রথমে গুলি করা হয় জাতীয় ছাত্রসমাজের তৎকালীন সভাপতি আবদুল হামিদকে। তারপর ডান হাতের কবজি কেটে দেয় শিবিরকর্মীরা। বিনা দোষে হাতের কর্মক্ষমতা হারানোর সে গ্লানি তিনি এখনো বয়ে চলেছেন।

চট্টগ্রাম কলেজ এখন শিবিরের দখলে। পাশের চট্টগ্রাম সরকারি মুহাম্মদ মহসিন কলেজও তাদের নিয়ন্ত্রণে। শুধু এই দুই কলেজ নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবিরের আধিপত্য। ১৮ হাজার ছাত্রছাত্রীর দেশের অন্যতম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ এক মিছিলে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ছাত্রমৈত্রী নেতা ফারুককে। ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এনামুল হকের ছেলে ও ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছাকে শিবিরকর্মীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে।

১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দখল করার জন্য শিবির ক্যাডাররা ছাত্র সংসদের ভিপি মোহাম্মদ জমির ও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফরিদউদ্দিন আহমদকে গুলি করার পর পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। এ প্রসঙ্গে ছাত্রদল মহানগর কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিবিরের আক্রমণে যারা মারা যায় তাদের অধিকাংশের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় তারা।'

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রামের আমির শামসুল ইসলাম এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাজনৈতিক মহলে শিবিরকে হেয় করার জন্য এসব অভিযোগ তোলা হয়। বরং শিবিরই বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।' 'শাহাদাতকে জবাই করে হত্যা ও হামিদের হাতের কবজি কেটে ফেলার অভিযোগ কি তাহলে মিথ্যা?' এ প্রশ্নের জবাবে জামায়াত নেতা বলেন, 'কারা দায়ী সেই খবর আপনারা (সাংবাদিকরা) নেন। শিবিরকে দায়ী করা যাবে না!'


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন