এস এম আজাদ
"কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিবির ক্যাডাররা আমাকে চাপাতির বাঁট আর লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। একপর্যায়ে বলে, 'তুই যদি ছাত্রলীগ ছেড়ে শিবির করিস, তাইলে তোর রগ কাটা হবে না।' আমি কোনো উত্তর না দিলে তারা চাপাতি ও ছুরি দিয়ে আমার হাত ও পায়ে আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠি। অসহ্য যন্ত্রণায় সারা শরীর অবশ হয়ে আসছিল। একপর্যায়ে তারা আমাকে আমার সাদা চাদরটি দিয়ে ঢেকে চলে যায়। এরপর কোনোমতে মোবাইল ফোন বের করি। কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।" এভাবেই শিবিরের নির্মম নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফিরোজ মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান (২৪)।
ব্যবস্থাপনা (বিবিএ) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ফিরোজ বর্তমানে ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। তাঁর সঙ্গে চিকিৎসাধীন একইভাবে শিবির ক্যাডারদের হামলার শিকার বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সাইফুর রহমান বাদশা (২৪)। গত মঙ্গলবার রাতে দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজশাহী থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। রাতেই দুজনের শরীরে অস্ত্রোপচারের পর পঙ্গু হাসপাতালের সি ওয়ার্ডে (দ্বিতীয় তলার পুরুষ ওয়ার্ড) ভর্তি করা হয়। গতকাল দুপুরে ২০৯ নম্বর কেবিনে নেয়া হয় তাঁদের। চিকিৎসকরা জানান, দুজনের কেউ-ই এখনো আশঙ্কামুক্ত নন।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বাদশার বাঁ হাতের চারটি আঙুল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ডান হাতের কব্জির রগ কাটা হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে। বাঁ পায়ের গোড়ালি পিটিয়ে জখম ও ওপরের রগ কাটা হয়েছে। পেছন থেকে ঘাড়ে দুই-তিনটি কোপের জখম রয়েছে। ফিরোজেরও দুই পায়ের গোড়ালি ও বাঁ হাতের আঙুল কুপিয়ে জখম করা হয়েছে।
ফিরোজ পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের সমর্থক। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত আছেন। তবে তিনি শুধুই কর্মী। কোনো পদে নেই। ছাত্রলীগ করার কারণেই শিবির ক্যাডাররা তাঁকে ধরে নিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটেছে বলে জানান তিনি।
ক্যাডাররা পুলিশ পরিচয় দেয় : হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ফিরোজ জানান, রাজশাহী শহরের বিনোদপুর মণ্ডলের মোড় এলাকায় তাঁর মেস। ক্যাম্পাসে উত্তেজনার খবর তিনিও পেয়েছিলেন। তবুও মেসে অনেকটা আয়েশ করেই রাতের খাবার শেষে ঘুমাতে যাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছয়জন অচেনা যুবক নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যেতে বলে। ফিরোজ তাঁদের সঙ্গে কিছুদূর গিয়ে আরো আটজনকে দেখতে পান। সেখানে আমির আলী হলের ছাত্রশিবির ক্যাডার একরাম, আরিফ ও স্থানীয় সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত বাবুকে ফিরোজ চিনতে পারেন। ফিরোজ জানান, সেখানে যেতেই ক্যাডাররা তাঁকে পেটানো শুরু করে।
ফিরোজ আরো বলেন, শিবির ক্যাডাররা চলে যাওয়ার পর আমার এক হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কোনোমতে সহকারী প্রক্টর আশরাফুল ইসলামকে আমার ওপর হামলার কথা জানাই। এর কিছু সময় পর আরেকজন শিবির কর্মী মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায়। অন্ধকারের কারণে কোন জায়গাটিতে তাঁকে ফেলে রাখা হয়েছিল তাও বলতে পারেননি ফিরোজ। সংজ্ঞা ফিরে দেখেন হাসপাতালে। ফিরোজ বলেন, শিবিরের এসব ক্যাডার বহিরাগত হওয়ায় তিনি সবাইকে চিনতে পারেননি। কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী কালের কণ্ঠকে জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনূসকে হত্যা করে যেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেই জায়গা থেকেই ফিরোজকে উদ্ধার করা হয়।
ফিরোজের বাড়ি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায়। বাবা হারুনুর রশিদ পল্লী চিকিৎসক। ফিরোজের অবস্থা আশঙ্কাজনক_টেলিভিশনে এ খবর শুনে মঙ্গলবার রাতেই ঢাকায় ছুটে এসেছেন বাবা। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ফিরোজই বড়। হারুনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। ফিরোজও এ রকম সমর্থক। তবে ক্যাম্পাসে কর্মী হিসেবে কাজ করলেও কোনো গণ্ডগোলে জড়ায়নি কখনো। শুধু দল করার কারণেই তাঁর ছেলের ওপর হামলা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জয়বাংলা স্লোগানের ফাঁদ : বাদশা থাকেন হবিবুর রহমান হলে। সোমবার রাতে শিবির ক্যাডারদের হামলার সময় পালাতে চেষ্টা করেন তিনি। জিয়া হলের পাশে শিবির ক্যাডারদের ফাঁদে পড়েন তিনি। বাদশা জানান, সোমবার রাতে শিবির ক্যাডাররা যখন হলগুলো ঘিরে ফেলছিল, তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতারা তাঁদের হলেই থাকতে নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে অস্ত্র হাতে ক্যাডারদের বিভিন্ন হলে ঢুকতে দেখে ছাত্রলীগ কর্মীরা পালাতে শুরু করে। হবিবুর রহমান হল থেকে ছাত্রলীগ কর্মী সোহাগের সঙ্গে বাদশা বের হয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় দেড়টা। জিয়া হলের কাছে গেলেই তাঁরা 'জয়বাংলা স্লোগান' শুনতে পান। নিজেদের নেতাকর্মী মনে করে সেখানে যেতেই কয়েকজন শিবির ক্যাডার তাঁদের ধরে রড দিয়ে পেটাতে শুরু করে। সোহাগ রডের আঘাতে পাশের ডোবায় পড়ে যান। তখন বাদশাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে যায় তারা। যন্ত্রণায় বাদশার মনে হচ্ছিল, তিনি মরে যাচ্ছেন। বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি হলের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকেন। একসময় হলের কাছে গেলে সাধারণ ছাত্ররা তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত ৩টার দিকে হামলাকারী শিবির ক্যাডাররা মিছিল করে ক্যাম্পাস ছাড়া পর্যন্ত নিজের জ্ঞান ছিল বলে জানান বাদশা।
বাদশার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে। বাবা আবদুল করিম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। চার ভাই-বোনের মধ্যে বাদশা সবার ছোট। ভাই-বোনরা সবাই স্কুলশিক্ষক।
আশঙ্কামুক্ত নন : আহত দুজন বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালের প্রফেসর ইকবাল কাভিলের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক ডা. আওয়াল রিজভী জানান, আহতদের শরীরে কয়েকটি করে 'সার্পকাট ইনজুরি' (গভীর পর্যন্ত কাটা) আছে। তাঁদের উভয়েরই রগ ও হাড় কাটা গেছে। মঙ্গলবার রাতেই এক দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেন, তাঁদের অবস্থা এখন ভালো, তবে এখনো আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। আজ বৃহস্পতিবার তাঁদের আরেকটি অস্ত্রোপচার করা হবে।
গতকাল বেলা ২টার দিকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মজিবর রহমান ফকির হাসপাতালে দুজনকে দেখতে যান। ওই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীও পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবদুল আওয়াল রিজভীকে ফোন করে আহতদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলী আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান।'
এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা গতকাল বাদশা ও ফিরোজকে দেখতে হাসপাতালে যান।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন