মাসুদ কার্জন
সপ্তাহ দুয়েক আগে এক রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে হাতিরপুলের দোতলা একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। বাড়িতে ঢুকে পুলিশের সদস্যরা আশ্চর্য বনে যান। দোতলা বাড়িটির মাত্র সাত থেকে আটটি কক্ষে গাদাগাদি করে বাস করেছেন একসঙ্গে ৪৪ জন। তাঁদের চারজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, বাসিন্দারা সবাই শিবিরের কর্মী-সমর্থক।
একসঙ্গে এতসংখ্যক কর্মী-সমর্থক থাকার কারণ জানতে চাইলে পুলিশের কাছে তাঁদের জবাব ছিল_এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। পুলিশ বাড়ির মালিক সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, বাড়ির মালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী প্রভাবশালী এক শিক্ষক। বাসিন্দাদের কাছ থেকে তিনি তেমন ভাড়াও নেন না।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শুধু ওই বাড়িটি নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে এরকম আরো অনেক বাড়িতে জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে অবস্থান নিয়েছে। মেস, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন নামে তারা মূলত আস্তানা গড়ে তুলেছে। এসব মেসবাড়ি সম্পর্কে স্থানীয়দেরও অনেক অভিযোগ। প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সাংগঠনিক আলাপ-আলোচনার জন্য এসব মেসে জড়ো হয় বাইরের আরো অনেক তরুণ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ এ ব্যাপারে সচেতন আছে এবং খোঁজখবর করা হচ্ছে। কেউ বাড়ি ভাড়ার নামে অপতৎপরতা চালালে অব্যশই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কাঁটাবন এলাকা ছাড়াও শাহবাগ, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড, বকশিবাজার, আলিয়া মাদ্রাসার আশপাশ, চানখাঁর পুলের নাজিম উদ্দিন রোড ও ফার্মগেটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় এরকম আরো অর্ধশত মেস আছে। ইতিমধ্যে এসব বাড়ি শনাক্ত করে বাসিন্দাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। রাজশাহী থেকে পুলিশের তাড়া খেয়েও মঙ্গলবার রাতেই কয়েক শিবির ক্যাডার এসব মেসে আশ্রয় নিয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। তাই এসব মেসের ওপর ইতিমধ্যেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
রহস্যজনক কাঁটাবন মসজিদ : ছাত্রলীগসহ একাধিক সূত্রের অভিযোগ, শিবিরের সবচেয়ে রহস্যজনক কর্মকাণ্ড চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায় কাঁটাবন মসজিদটি ঘিরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় গড়ে তোলা এ মসজিদটি পুরোপুরি জামায়াত শিাবরের নিয়ন্ত্রণে। মসজিদের আশপাশের দোকানগুলোও ওদের কর্মী-সমর্থকরা চালান। জামায়াত-শিবিরের প্রকাশনা বই, সিডি ও ক্যাসেট বিক্রি হয় এসব দোকানে। জানা গেছে, চারতলার এ ভবনটিতে মসজিদ ছাড়াও মহিলাদের জন্য নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা এবং একটি মাদ্রাসা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জামায়াতের মহিলা নেতা-কর্মীরাও এ মসজিদে আসেন।
মসজিদ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন জয়নুল আবেদীন। তিনি যাত্রাবাড়ী তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য। গতকাল বুধবার সরেজমিন কাঁটাবন মসজিদে গিয়ে কমিটির সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বলা হয়, 'সভাপতি মাসে একবার আসেন। মিটিং ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছাড়া এ মসজিদে আসেন না তিনি।'
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, এ মসজিদটি অন্যসব মসজিদ থেকে একটু আলাদা। সব মসজিদে শুধু নামাজের সময় লোকজনের আনাগোনা বাড়ে; কিন্তু এ মসজিদটিতে সব সময় লোকজনের যাতায়াত থাকে। আগন্তুকদের বেশিরভাগই তরুণ বয়সের। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার মতে, প্রতিরাতে অনেক শিবিরকর্মী এ মসজিদে পালা করে ঘুমায়। এ মসজিদটি নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এ পর্যন্ত প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মানিকনগর ক্যাম্পাসে ইসলামী শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান মাওলানা রফিকুর রহমান কাঁটাবন মসজিদের খতিব। বিতর্কিত জামায়াত-শিবিরের মসজিদে নামাজ পড়ানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি শুধু শুক্রবার জুমার খুতবা পড়াই। জামায়াতের সঙ্গে আমি সরাসরি জড়িত নই। দলে কোনো পদও নেই।'
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আমজাদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু কাঁটাবন মসজিদটি নয়, আশপাশের মার্কেটও বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় গড়ে উঠেছে। এসব জায়গা একটি বিশেষ গোষ্ঠী দখল করে রেখেছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহবাগে শেরাটন হোটেলের পশ্চিম পাশের হাবিবুল্লাহ রোডে পাঁচতলা একটি বাড়িতেও শিবিরের দুটি কোচিং সেন্টার আছে। শিবির কমী-সমর্থকরা এখান থেকেও তাঁদের কর্মতৎপরতা চালান। বাড়ির মালিক আব্দুর রাজ্জাক পাঁচতলায় থাকেন। অন্য চারটি তলায় শিবিরের কর্মী সমর্থকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রেটিনা ও ফোকাস নামে এ বাড়িতে দুটি কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড আছে। পাশের একটি বাড়ির ভাড়াটিয়া নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে কালের কণ্ঠকে জানান, এ বাড়ি ছাড়াও শাহবাগ এলাকায় হাবিবুল্লাহ রোডের আরো দুটি বাড়িতে শিবির আস্তানা গড়ে তুলেছে। সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার এদের তৎপরতা চোখে পড়ে। এ দুই দিন বাইরে থেকে আরো কর্মী-সমর্থক এসে এইখানে জড়ো হয়। তিনি আরো বলেন, এ এলাকায় মূলত জামায়াতপন্থী চিকিৎসক বা মেডিক্যাল ছাত্ররা আসেন।
তবে রেটিনা কোচিং সেন্টারে গেলে তাঁদের একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানে শুধু ক্লাস হয়। শিবিরের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম চলে না।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন