টিপু সুলতান | তারিখ: ১৮-০২-২০১০
৮ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রথম দফা হামলার অন্তত দেড় ঘণ্টা আগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা ঘটনাটি সম্পর্কে জানতেন। আর ছাত্রলীগের ওপর গভীর রাতে দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চলাকালে শিবির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা।
ওই রাতে রাজশাহীতে আক্রমণ পরিচালনাকারী মাঠ পর্যায়ের ও কেন্দ্রীয় শিবির নেতাদের টেলিফোনের যোগাযোগের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের তাণ্ডব, ছাত্র হত্যা ও ম্যানহোলে লাশ লুকানোর ঘটনার বিষয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধানে নেমেছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে রাজশাহীতে শিবিরের আক্রমণের ওই ঘটনা সম্পর্কে রাতভর খোঁজ-খবর নিয়েছেন ঢাকা থেকে শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা।
অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ওই রাতে কারও সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেননি। তিনি তখন খুলনায় ছিলেন।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও মাঠ পর্যায় থেকে প্রথম আলোর পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টা ৫০ মিনিট থেকেই শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করিম সংগঠনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে বঙ্গবন্ধু হলে প্রথম আক্রমণ হয়। এর আগ মুহূর্তে এবং পরে দফায় দফায় কেন্দ্রীয় সভাপতি টেলিফোনে কথা বলেন শিবিরের সৈয়দ আমীর আলী হল শাখার সভাপতি আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। প্রথম আক্রমণে আহত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ কর্মী কাওসার আলম ও আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই আক্রমণে নেতৃত্ব দেন আরিফুল ইসলাম ও শিবিরের বঙ্গবন্ধু হল শাখার সাধারণ সম্পাদক খালিদ হোসাইন।
আরিফুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থানকারী শিবির নেতাদের প্রায় সারা রাতই দফায় দফায় ফোনে যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে।
শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল পরদিন সকাল পর্যন্ত মোবাইল ফোনে রাজশাহীর শিবির নেতা-ক্যাডার ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন। রেজাউল নিজেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সাবেক নেতা দোলোয়ার হোসেন ওই রাতে হামলার আগ মুহূর্ত থেকে শেষ পর্যন্ত মাঠপর্যায়ের ক্যাডারদের দিক-নির্দেশনা দেন বলে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তিনি ঢাকায় বসেই ফোনে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্থানীয় ক্যাডারদের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন। এর প্রমাণ মিলেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি সামছুল আলম ওরফে গোলাপও কিছুক্ষণ পর পর কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউলের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।
তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই রাতে ঢাকা থেকে শিবিরের ক্যাডার কাফিকে রাজশাহী পাঠানো হয়। কাফি রাজশাহী পৌঁছান পরদিন সকালে। কিন্তু তিনি রাজশাহী যাওয়ার সময় রাতভর ফোনে আক্রমণকারী ক্যাডার ও কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পর্যালোচনা হচ্ছে, দেলোয়ার ও কাফি আক্রমণের সার্বিক তদারক করেন মোবাইল ফোনে। ঘটনার প্রতি মুহূর্তের অবস্থা জানান কেন্দ্রীয় সভাপতিকে। আবার এঁদের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সামছুল আলম, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ (বর্তমানে সান্ধ্যকালীন এমবিএ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে) অন্যদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল যোগাযোগ করে দফায় দফায় কথা বলেন এবং একই সঙ্গে তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর ফোনের কল তালিকা থেকে এর প্রমাণ মিলেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে।
প্রথম আলোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, এক দফা হামলার পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তাতে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে, কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আবাসিক হলগুলোর প্রাধ্যক্ষরাও ফিরে যান। কিন্তু রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে শিবির কর্মীরা একযোগে সবগুলো হলে আক্রমণ শুরু করে।
সাড়ে ১২টা থেকে এই মধ্যবর্তী সময়ে শিবিরের কেন্দ্রীয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মধ্যেও ফোনে কথাবার্তা অব্যাহত ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের ধারণা, এ সময় পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুতি চলে।
গভীর রাতে শাহ মখদুম হলের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুককে নৃশংসভাবে হত্যা ও লাশ গুমের ঘটনার সময় বা আগে-পরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন।
কল তালিকা থেকে জানা যায়, শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল রাত দুইটা ২৩ মিনিটে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে ফোন করেন। এরপর রেজাউল একাধিকবার জামায়াতের ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। আবার তার আগে রাত দুইটা ১৭ মিনিটে রফিকুল ইসলাম ফোন করেছিলেন জনাব মুজাহিদকে। তখন কথা বলেন প্রায় তিন মিনিট। মুজাহিদ নিজেও শিবির সভাপতিকে ফোন করেন ৯ ফেব্রুয়ারি ভোর সোয়া ছয়টায়। স্থানীয় সূত্রগুলো মতে, তখন শিবিরের আক্রমণ শেষ পর্যায়ে।
কিন্তু জনাব মুজাহিদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি রাজশাহীর হতাহতের ঘটনা জেনেছেন পরদিন। ওই রাতে তাঁর ফোন থেকে তিনি কারও সঙ্গে কোনো কথা বলার কথা অস্বীকার করেন।
কিন্তু রাত দুইটা ১৭ মিনিট, দুইটা ২৩ মিনিট ও ভোরে রেজাউল ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার প্রমাণ আছে বলা হলে জনাব মুজাহিদ বলেন, ‘আমার ফোনটা আমার এপিএসের কাছেও থাকে। সে ওই রাতে কারও সঙ্গে কথা বলেছে কি না, তা আমি জানার চেষ্টা করব।’
অবশ্য আরেক প্রশ্নের জবাবে জনাব মুজাহিদ বলেন, তাঁর অনুমতি ছাড়া এপিএস (একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী) কারও সঙ্গে কথা বলার কথা নয়।
এ ছাড়া শিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির সঙ্গেও রফিকুল ইসলাম ও জামায়াতের প্রচার সম্পাদক তাসনিম আলমের ফোনে যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খান ওই রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি পরদিন পত্রিকা পড়ে ও টেলিভিশন দেখে রাজশাহীর ঘটনা সম্পর্কে প্রথম জেনেছেন বলে জানান।
কিন্তু রাতে মুজাহিদ ও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে টেলিফোনে তাঁর যোগাযোগের সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’
শিবির সভাপতির বক্তব্য জানার জন্য বারবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া ওই রাতে কেন্দ্রীয় নেতা ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন এমন আরও অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। এঁদের অনেককে পুলিশ ইতিমধ্যে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিবিরের এসব সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীর মধ্যে রয়েছেন মো. আমিনুল, জুলকার নাইন, মিজানুর রহমান, গাজী মামুন, মো. কাদের, গোলাম আরিফ, আতিকুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল মামুন, অহিদুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, আজিবুল হক, আনারুল ইসলাম, একরাম হোসাইন, মতিন।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, শিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক দুই সভাপতি নুরুল ইসলাম ও ইমাজ উদ্দিন মণ্ডল ওই রাতে আক্রমণকারী ক্যাডারদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে নুরুল ইসলাম ঢাকা থেকে এবং ইমাজউদ্দিন রাজশাহীতে ছিলেন। ইমাজ বর্তমানে জামায়াতের রাজশাহী মহানগর শাখার প্রচার সম্পাদক, চাকরি করেন নওদাপাড়া ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি জামায়াতের মহানগর আমির আতাউর রহমানের মেয়ের জামাই। তিনি ওই রাতে শ্বশুরের বাসার টিঅ্যান্ডটি ফোনেও অনেকবার যোগাযোগ করেন। ইমাজের ফোন নম্বরটি এখন বন্ধ রয়েছে।
সাবেক শিবির নেতাদের মধ্যে মো. আলাউদ্দিন, মোতাহার হোসেন ও নজরুল ইসলামও ওই রাতে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন।
এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত তদারককারী রাজশাহী মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, তাঁরা ইতিমধ্যে রাজশাহী মহানগর জামায়াতের আমির আতাউর রহমানের সঙ্গে ওই রাতে আক্রমণকারী শিবির ক্যাডারদের যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি না, তাও তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন