12 February 2010

চট্টগ্রামের হাসপাতালে মহিউদ্দিনের লাশ নিয়ে টানাটানিঃ শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে ১২ পুলিশ আহত




নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম | তারিখ: ১৩-০২-২০১০


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহত এ এ এম মহিউদ্দিন ওরফে মাসুমকে দলীয় কর্মী দাবি করে জামায়াত-শিবির গতকাল শুক্রবার দুপুরে নগরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। তারা জামালখান এলাকায় মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় তারা পুলিশের ওপর চড়াও হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে ১০ পুলিশসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়। এদিকে ছাত্রলীগও মহিউদ্দিনকে নিজেদের কর্মী দাবি করে নগরে মিছিল করেছে।

পুলিশ জামালখান থেকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী সন্দেহে ৯৬ জনকে আটক করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। পরে ১০ জনকে ছেড়ে দিয়ে ৮৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধাদান, পুলিশের ওপর হামলা, বিস্ফোরক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। এ ব্যাপারে একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে।

নিহত মাসুমের মা হাসিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে শিবির করে না, বরং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আমার স্বামী সরকারি চাকরি হারিয়েছে। এ সরকার চাকরি ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের পরিবার রক্ষা করেছে।’ মহিউদ্দিনের এক খালাতো ভাইসহ স্বজনদেরও দাবি, তিনি সক্রিয় রাজনীতি না করলেও ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন।

তবে জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম নগর শাখার আমির সাংসদ আ ন ম শামসুল ইসলাম গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, মহিউদ্দিন শিবিরের কর্মী ছিলেন। মহিউদ্দিনের পরিবারের বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি শিবিরের সমর্থক ছিলেন। হলে থাকতেন, দায়িত্বশীল কোনো পদে ছিলেন না। এ জন্য অনেকে তাঁকে চেনে না। বাবা আওয়ামী লীগ করলেও তিনি শিবির করতেন।’ গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টার দিকে নগরের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে মাসুমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং ইট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। শহরে টিউশনি শেষ করে ক্যাম্পাসে ফিরতে ওই সময় তিনি স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

লাশ নিয়ে কাড়াকাড়ি: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিনের লাশ নেওয়ার জন্য জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা গতকাল সকাল থেকে মর্গের আশপাশে জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা জোর করে তাঁর মরদেহ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশের অনড় ভূমিকার কারণে তা পারেননি। বেলা ১১টার দিকে তাঁরা মর্গের সামনে মরদেহ ছাড়াই মহিউদ্দিনের গায়েবানা জানাজা আদায় করেন এবং মিছিল বের করেন। এই ফাঁকে কড়া পুলিশি পাহারায় মহিউদ্দিনের মরদেহ কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। জামায়াত-শিবিরের কয়েকজন কর্মী অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়লেও পুলিশ তাঁদের জোর করে নামিয়ে দেয়।

মিছিল ও সংঘর্ষ: জামায়াত-শিবিরের মিছিলটি মেহদিবাগ হয়ে আসকার দীঘিরপাড় ধরে জামালখানের দিকে আসতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষোভ মিছিলটি জামালখানের খাস্তগীর স্কুল মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ এতে বাধা দেয়। এ সময় মিছিল থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম এবং কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউদ্দিন মাহমুদ আহত হন।

এর পরই পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় তাঁরা আশপাশের গলি, মাদ্রাসা, বহুতল ভবন ও নালায় লুকিয়ে পড়েন।

সংঘর্ষে আহত অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন অনুদ্র (নম্বর-১৯৮৩), আলমগীর (২০১৫), আকাশ (২০৩), জাহিদ আজিজ (৪১৮৮), হেলাল (৬০১), আলতাফ (৪২৯), গৌতম (১০৮৫), নিজাম (১০৮৫), নজরুল (৪৪৭৪) ও নিজাম (৩৯৪৩)। এঁদের পুলিশ লাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মিছিল না করতে বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এর পরই পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’

জামালখানে লাঠিচার্জের পর শিবিরের কর্মীরা আন্দরকিল্লায় সংগঠিত হতে পারেন—এমন আশঙ্কায় আন্দরকিল্লা মোড়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। তবে সেখানে শিবিরের নেতা-কর্মীরা মিছিল-সমাবেশের চেষ্টা করেননি।

মামলা: গত বৃহস্পতিবার রাতের খুনের ঘটনায় নিহত মাসুমের বাবা ফজলুল কাদের বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় নাম-পরিচয় উল্লেখ না করে অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্ত করছেন রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সহিদ উল্লাহ।

ছাত্রলীগের মিছিল-সমাবেশ: জুমার নামাজের পর মহিউদ্দিনকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে গায়েবানা জানাজা আদায় করে নগর ছাত্রলীগ। জানাজা শেষে নগর সভাপতি এম আর আজিমের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। পরে জেলা পরিষদ চত্বরে এক প্রতিবাদ সভা হয়। এ সময় নগর সাধারণ সম্পাদক মো. সালাউদ্দিন ও সহসভাপতি জহির উদ্দিন বক্তৃতা করেন।

জামায়াতের সংবাদ সম্মেলন: মহানগর জামায়াতের দেওয়ানবাজার কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিসহ পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। দাবির মধ্যে আছে গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি, মহিউদ্দিনের খুনিদের গ্রেপ্তার ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, পুলিশের লাঠিপেটায় সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীসহ ১৫০ জন নেতা-কর্মী আহত হন। এ সময় কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মোমিনুল হক চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আমির জাফর সাদেক, সেক্রেটারি মো. নুরুল্লাহ ও নগর সেক্রেটারি মো. নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠক: স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক গতকাল রাতে চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর ঘটনায় চট্টগ্রামকে উত্তেজিত করতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে জামায়াত-শিবির। মহিউদ্দিনকে আমি চিনি। তাঁর গোটা পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক।’ বৈঠকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবিরের গোপন আস্তানায় অভিযান জোরদার করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।

বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, নগর পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন