28 February 2010

পাকিস্তানিসহ পাঁচ জঙ্গি গ্রেপ্তার, একজন বিমান ছিনতাইকারী!

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ০১-০৩-২০১০


পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশে মুহাম্মদের দুই সদস্যসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। শনিবার গভীর রাতে রাজধানীর মিরপুর রোড থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এদের মধ্যে একজন পাকিস্তানি নাগরিক, যিনি লস্কর-ই-তাইয়েবার সহযোগী সংগঠন জইশে মুহাম্মদের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বলে উল্লেখ করেছে র‌্যাব।

গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজন হচ্ছেন রেজোয়ান আহমেদ (২৬), নান্নু মিয়া ওরফে বেলাল মণ্ডল ওরফে বিল্লাল (৩৫), ইমাদ উদ্দিন ওরফে মুন্না (১৮), সাদেক হোসেন ওরফে খোকা (১৯) ও আবু নাসের মুন্সী (২৮)।
র‌্যাব জানায়, রেজোয়ান আহমেদ পাকিস্তানি নাগরিক। তিনি জইশে মুহাম্মদের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী। জইশের অন্য সদস্য নান্নু মিয়া ওরফে বেলাল সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত এবং এ জন্য ১০ বছর ভারতের কারাগারে ছিলেন। বেলাল নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করলেও তাৎক্ষণিকভাবে র‌্যাব তা নিশ্চিত হতে পারেনি।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, বাকি তিনজন এঁদের এখানকার সহযোগী বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে। র‌্যাব সূত্র আরও জানায়, এসব জঙ্গি মূলত বাংলাদেশে বসে ভারতে নাশকতার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কাজ পরিচালনা করেন।

গতকাল রোববার র‌্যাব সদর দপ্তরে আটক জঙ্গিদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়। এ সময় র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল এস এম মতিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, নাশকতামূলক কার্যক্রম চালানোর জন্য মিরপুর রোডের সুকন্যা টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটে জইশে মুহাম্মদের কিছু প্রশিক্ষিত জঙ্গি অবস্থান করছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার রাত সাড়ে তিনটায় র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২-এর একটি যৌথ দল সুকন্যা টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটে (৫/এফ) অভিযান চালিয়ে রেজোয়ান, ইমাদ উদ্দিন, সাদেক হোসেন ও নাসেরকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে দুটি পাকিস্তানি ও একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ধারালো চাকু, কম্পিউটারের সিপিইউ, পরিচয়পত্র ও বৈদেশিক মুদ্রা আটক করা হয়।

কর্নেল এস এম মতিউর রহমান বলেন, ওই চারজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোববার ভোর সাড়ে পাঁচটায় নিউমার্কেট-সংলগ্ন ফুটওভারব্রিজের পাশ থেকে নান্নু মিয়া ওরফে বেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই চক্রের আরেক সদস্য পাকিস্তানি জঙ্গি জওয়াদকে ধরা যায়নি। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে। সুকন্যা টাওয়ারের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা দুটি পাসপোর্টের একটি জওয়াদের।

র‌্যাব সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে রেজোয়ানের বাড়ি পাকিস্তানের করাচির ক্লিফটনের দিল্লি কলোনি এলাকায়। তাঁর পাসপোর্টেও এই ঠিকানা লেখা রয়েছে। র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রেজোয়ান হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় পারদর্শী। তিনি আরপিজি (রকেটচালিত গ্রেনেড), ভারী মেশিনগান ও স্নাইপার রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালনা এবং চলন্ত রেলে বোমা হামলার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আত্মঘাতী হামলা চালাতেও প্রস্তুত রেজোয়ান।

র‌্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে রেজোয়ান আরও জানান, তিনি ঢাকায় অবস্থান করে জইশের আঞ্চলিক সমন্বয় এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশে সদস্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করতেন। র‌্যাব সূত্র জানায়, রেজোয়ান সাড়ে তিন বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তিনি বৈধ ভিসা নিয়ে এ দেশে ঢোকেন।

এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া বেলাল জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তাঁর বাড়ি সিলেটের কোতোয়ালি থানার দরমপুর নামের এক জায়গায়। তবে তাঁর দেওয়া এ ঠিকানা সঠিক কি না, র‌্যাব এখনো তা যাচাই করতে পারেনি।
সংবাদ ব্রিফিংয়ের পর বেলাল সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ভারতের আসামের গুয়াহাটিতে বিয়ে করেছেন। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিদের বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাতায়াতে সহায়তা করাই তাঁর কাজ ছিল বলে দাবি করেন বেলাল। তিনি সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে এসব জঙ্গিকে আনা-নেওয়া করতেন। বেলাল আরও বলেন, ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুতে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান ছিনতাইয়ে তিনি জড়িত ছিলেন। এ জন্য তিনি ১০ বছর গুয়াহাটি কারাগারে আটক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতের বসিরহাটে আরও চারটি মামলা রয়েছে। তাই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।

র‌্যাব কর্মকর্তারাও বেলাল সম্পর্কে প্রায় একই তথ্য দিয়ে বলেছেন, আট মাস আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতীয় ওই বিমান ছিনতাইয়ে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিরা জড়িত ছিল। তারা ১৮০ জন যাত্রীসহ বিমানটি অমৃতসর, লাহোর ও দুবাই হয়ে আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিয়ে যায়। পরে ভারতের কারাগার থেকে পাকিস্তানের হরকাতুল আনসারের তত্কালীন মহাসচিব মাসুদ আজহার (পরে জইশে মুহাম্মদের প্রতিষ্ঠাতা), আহমেদ ওমর সাইদ শেখ (পরে মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) ও আল-উমর মুজাহিদীনের নেতা মুশতাক আহমেদ জারগারকে (ভারতীয় নাগরিক) মুক্তি দিয়ে নিরাপদে আফগানিস্তানে যাওয়ার সুযোগ দিলে ওই বিমান ছিনতাইয়ের অবসান হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া অন্য তিনজনের মধ্যে ইমাদ উদ্দিন ও সাদেক হোসেন আপন ভাই এবং আবু নাসের তাঁদের চাচাতো ভাই। নাসের জঙ্গিদের স্থানীয় গাইড হিসেবে কাজ করতেন। আর ইমাম ও সাদেক অন্য বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতেন।

র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার কমান্ডার এম সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, এই তিনজন মূলত পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিদের এ দেশে আশ্রয় পেতে সহযোগিতা করেছেন। ইমাদের বাবা মহিউদ্দিন ঢাকায় পাকিস্তানি জঙ্গিদের একজন বড় আশ্রয়দাতা। তাঁরা ঢাকার নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে বিদেশি জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।

কমান্ডার এম সোহায়েল জানান, মহিউদ্দিন এখন পলাতক। তিনি আগে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং এখন হাজীগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর বড়কুল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। মহিউদ্দিনের ভাই সালাহউদ্দিনও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনিও পলাতক।

এদিকে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রেজোয়ান ও বেলালকে কয়েক দিন আগেই একটি গোয়েন্দা সংস্থা আটক করেছিল। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই রোববার অন্য তিনজনসহ তাঁদের গণমাধ্যমের সামনে উপস্থিত করা হয়।

পিটিআইকে উদ্ধৃত করে প্রভাবশালী দ্য হিন্দু পত্রিকা জানিয়েছিল, ২০০০ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বেলালকে। ওই খবরে বলা হয়, বেলাল ওই ছিনতাই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী এবং এ ঘটনায় আটক চতুর্থ ব্যক্তি। তাঁকে ওই বছরের জুনে আসাম পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে তাঁর নামে আরও অভিযোগ ছিল। এদিকে সন্ত্রাসবাদবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘সাউথ এশিয়ান টেররিজম পোর্টাল’-এ বলা হয়েছে, বেলাল পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিলেন, তিনি আসামের ৪০ জন মুসলিম যুবককে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে হরকাত-উল-মুজাহিদীনের প্রশিক্ষণ নিতে সহায়তা করেন।

আমাদের হাজীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বিএনপির উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান মোল্লা বলেছেন, মহিউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপিতে যোগ দেন। এখন তিনি বিএনপির বড়কুল ইউনিয়ন শাখার সভাপতি। ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে তাঁর একটি জুতার দোকান আছে। মিরপুর রোডে রয়েছে নিজস্ব বাড়ি। মহিউদ্দিন সম্পর্কে এর বেশি তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন বিএনপির এই নেতা।

এ দিকে গতকাল চেষ্টা করেও মহিউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোনসেট বন্ধ ছিল। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গতকালও তাঁকে নিজ গ্রামে দেখা গেছে।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন