26 February 2010

সশস্ত্র বাহিনীকে লক্ষ্য করে উসকানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে নিষিদ্ধ হিযবুত




টিপু সুলতান | তারিখ: ২৭-০২-২০১০


পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে উসকানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশসহ ২০টি দেশে নিষিদ্ধ উগ্রপন্থী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর। সংগঠনটি একই সঙ্গে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য পোস্টার সাঁটানো, প্রচারপত্র বিলি ও ওয়েবসাইটে অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিডিআর বিদ্রোহের সহযোগী আখ্যায়িত করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘প্রতিশোধ স্পৃহায় জাগ্রত হওয়ার’ আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি সংগঠনটি প্রচারপত্র ছেড়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্র কার্যালয়ে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এক লাখ প্রচারপত্র বিলির দাবি করেছে তারা।

এ জাতীয় বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি ও দেয়ালে পোস্টার সাঁটানোর সময় গত দুই মাসে হিযবুত তাহরীরের অন্তত ৫০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। সংগঠনটির মূল শক্তি ও কার্যক্রম ঢাকাভিত্তিক হলেও চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটে তাদের গোপন কর্মকাণ্ড রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এই বেআইনি সংগঠনের গোপন-প্রকাশ্য সব তৎপরতার ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছেন। একই সঙ্গে অভিযানও অব্যাহত আছে।

গত বছরের ২২ অক্টোবর সরকার উগ্রপন্থী এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটির কার্যক্রম এ দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর পর থেকে সংগঠনটির এ দেশের প্রধান সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ অনেকটা গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন। এর পর থেকে সংগঠনটির গোপন তত্পরতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন ১৩ নেতাকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা শনাক্ত করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে। হিযবুত তাহরীরের বর্তমান এই ১৩ কর্ণধার হলেন গোলাম মাওলা (জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা), শেখ তৌফিক (রাজনৈতিক সচিব), কাজী মোরশেদুল হক (যুগ্ম সমন্বয়কারী), মাওলানা মামুনুর রশীদ (গণসংযোগ সচিব), মুস্তফা মিনহাজ (মিডিয়া ও প্রচার সচিব) এবং কার্যকরী সদস্য সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনছারী, আহমদ জামান, মনির হোসেন, সাইদ, গোলাম মোস্তফা, ঢাকা মহানগর সমন্বয়কারী শাহজালাল মিয়া ও মহিলা শাখার সমন্বয়ক ফাহমিদা খানম। পুলিশের চোখে তাঁরা সবাই পলাতক।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনটির কার্যক্রম এ দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার পর কর্মীদের গোপন তৎপরতা বেড়ে যায়। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে পোস্টার সাঁটিয়ে, প্রচারপত্র বিলি করে অল্প সময়ের মধ্যে আবার গা-ঢাকা দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটির শ খানেক সদস্য রাজধানীর পল্টন মোড়ে মাইক্রোবাসযোগে এসে হঠাৎ ব্যানার-পোস্টার নিয়ে মিছিল বের করেন। টের পেয়ে পুলিশ দ্রুত বাধা দিলে মিছিলকারীরা পালিয়ে যান। সেখান থেকে দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন এমন একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সালে এই সংগঠনটি এ দেশে আত্মপ্রকাশের পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘কুফর’ আখ্যায়িত করে তাদের ভাষায় ‘খিলাফত রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলত। তারা বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে সভা-সেমিনার এবং প্রচারপত্রের মাধ্যমে কার্যক্রম চালাত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে তারা অন্য মৌলবাদী সংগঠনগুলোর মতো ভারতবিরোধিতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। শীতাতপ কক্ষের বদলে তারা বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করে শক্তিমত্তার মহড়া দিতে শুরু করে। এমনকি জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে রাজপথে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। তারা পরদিনই বিডিআর বিদ্রোহের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করে প্রচারপত্র ছাড়ে। এরপর একাধিক আলোচনা সভায় একই বক্তব্য হাজির করে।

অভিযোগ আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এসব কাজে একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আর্থিক সুবিধাসহ বিভিন্নভাবে উত্সাহ পায় হিযবুত তাহরীর। অবশ্য তখন সংগঠনটির একাধিক নেতা এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে ওই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্বীকার করলেও আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

অর্থ আসে বিদেশ থেকে: সম্প্রতি সরকারকে দেওয়া প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, হিযবুত তাহরীর গোপন-প্রকাশ্য নানা কর্মকাণ্ড চালাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। তারা নানাভাবে যুক্তরাজ্য হিযবুত তাহরীর থেকে আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে।

বাংলাদেশে নিষিদ্ধের পর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভও করেছে সেখানকার হিযবুত তাহরীরের সমর্থকেরা। ২০০৫ সালের মে মাসে লন্ডনে হিযবুত তাহরীরের একাধিক নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তখন সংগঠনটির যুক্তরাজ্য শাখার নেতা লুটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের কর্মকাণ্ড সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়ার উপায় সম্পর্কে এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান এবং এ জন্য তাঁদের বড় ধরনের বাজেট আছে বলেও জানান।

তবে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে প্রধান সমন্বয়কারী মহিউদ্দিন আহমদসহ একাধিক নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের এ বিষয়ে কথা হয়। তখন তাঁরা দাবি করেন, সংগঠনের প্রায় সব সদস্য সচ্ছল পরিবারের সদস্য। সবাই মাসিক চাঁদা দেন। এ ছাড়া অনেক সদস্য আছেন উচ্চ বেতনে চাকরি করেন, তাঁরা বেতনের একটা অংশ প্রতিমাসে সংগঠনকে দেন। এ টাকায় সংগঠন পরিচালিত হয়।

তত্পর আরও নানা নামে: অভিযোগ রয়েছে, হিযবুত তাহরীর কক্সবাজার এলাকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও কিছু তত্পরতায় যুক্ত। তবে এ ক্ষেত্রে তারা একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে সভা-সেমিনার করে, যাতে সশস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর একাধিক নেতার উপস্থিতি দেখা গেছে। ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন ট্রাস্টি হলেন হিযবুত তাহরীরের এ দেশের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শেখ তৌফিক। এ ছাড়া ছাত্রমুক্তি নামে হিযবুতের ছাত্র সংগঠন রয়েছে। রয়েছে একাধিক কথিত সামাজিক সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠন। একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টারও আছে। এর মধ্যে সেগুনবাগিচায় ‘ব্ল্যাক ডট নেট’ ও কারওয়ান বাজার এলাকায় ‘ডট নেট’ নামে দুটি আইটি প্রতিষ্ঠানকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) জঙ্গি দমনসংক্রান্ত বিশেষ দল শনাক্ত করেছে এবং গত বুধবার অভিযান চালিয়ে কিছু মালামাল জব্দ করে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান থেকেও হিযবুতের পোস্টার, প্রচারপত্র ইত্যাদি তৈরির কাজ হতো বলে এসবি প্রমাণ পেয়েছে।

অসমর্থিত একটি সূত্র জানায়, দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের একটা যোগাযোগ হয়েছে।

মেধাবী ছাত্রদের দলে ভেড়াতে তৎপরতা: নিষিদ্ধ হওয়ার পরও রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিযবুত তাহরীর সদস্যরা গোপনে সাংগঠনিক তৎপরতা ও সদস্যসংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষকও নিষিদ্ধ সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের লক্ষ্য করে সংগঠনের সদস্যসংগ্রহ কর্মসূচি চালাচ্ছেন। তাঁরা পবিত্র ধর্মের নামে উগ্র মতবাদও ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

পুলিশ কমিশনার শহীদুল হক বলেন, অতীতে মাওবাদী নকশালপন্থী বা গণবাহিনী যেভাবে তরুণদের মগজ ধোলাই করে বিপথে নিয়েছিল, হিযবুত তাহরীরও অনেকটা সেভাবেই করছে। এ ক্ষেত্রে তারা পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, এদের অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠন ব্যবহার করলে সেটা হবে ভয়ংকর। এ জন্য অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে সন্তানেরা কাদের সঙ্গে মিশছে। আগে থেকে সরিয়ে আনতে না পারলে পরে এসব ছেলে আর মা-বাবার নিয়ন্ত্রণে থাকে না।


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন