10 February 2010

দারিদ্র্য দমাতে পারেনি, বর্বরতার কাছে হার


আসাদুল ইসলাম, জয়পুরহাট | তারিখ: ১০-০২-২০১০


বাড়িজুড়ে দারিদ্র্যের ছাপ। ঘর বলতে একটি মাটির ছাপরা। মাটির ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাঁশের বেড়ায় তৈরি একটা ছোট্ট কুঠিঘর। সেখানে একটা কাঠের চৌকি। বাড়িতে এলে ফারুক এখানে থাকতেন।
গতকাল জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার ভাদসা ইউনিয়নের খোর্দ্দ সগুনা গ্রামে ফারুকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল বাড়ির পাশে তাঁর কবর খোঁড়া হচ্ছে। নির্বাক হয়ে বসে আছেন বাবা ফজলুর রহমান। বিলাপ করছেন মা হাছনা বানু আর দুই বোন।

বাবা ফজলুর রহমানের একমাত্র ছেলে ফারুক হোসেন। তাঁর লেখাপড়ার জন্য দেড় বিঘা জমি বন্ধক রেখেছেন বাবা। আর এক বিঘায় আবাদ করে কোনো রকমে সংসার চালান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ তো চলে না। তাই তিন বছর আগে সদর উপজেলার দোগাছী গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৬৭ হাজার টাকা শিক্ষাঋণ নিয়েছেন বাবা। তিন মাস পর পর গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে তুলে ছেলেকে দিতেন। ২ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকা তোলা হয়। সেই টাকা নিয়ে ফারুক বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। হয়তো আবার আসতেন তিন মাস পর। কিন্তু ফারুক ফিরে এসেছেন গতকাল। লাশ হয়ে।




ছেলে ফারুক ছিল তাঁর আশার ধন। সেই ছেলের লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে নামাতে হবে বাবা ফজলুর রহমানকে। এই ভার বাবা সইবেন কী করেঃ ছবি: প্রথম আলো


গত সোমবার সন্ধ্যায় চাচি আলতা বানুর মোবাইলে ফোন করে ফারুক কথা বলেন মা হাছনা বানুর সঙ্গে। এটাই ছিল ফারুকের সঙ্গে মায়ের শেষ যোগাযোগ। হাছনা বানু জানান, ‘ফোনে ছেলে বলেছে, মা একটু ধৈর্য ধর। বাবাকে বোঝাও, আর একটা বছর কষ্ট কর। পড়া শেষ হলে একটা চাকরি যেভাবেই হোক জোগাড় করতে পারলে সংসার নিয়ে আর তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।’

প্রতিবেশী দাদা আবদুস ছাত্তার বলেন, ‘বাড়িতে এলে ফারুক সবারই খোঁজখবর নিত। খুব ভদ্র ছিল। গরিব ঘরের হলেও সে গ্রামের গর্ব ছিল।’ তিনি বলেন, ‘ফজলুর আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। অনেক সময় খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করে। ছেলেটাকে নিয়েই ছিল তার যত আশা।’

বাবা ফজলুর রহমান জানান, তাঁরা ভোটের সময় নৌকায় ভোট দিতেন। ছেলেকেও নৌকায় ভোট দিতে বলতেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ফারুক ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তা তিনি জানতেন না।
গতকাল দুপুরে ফারুকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশীরা সব ছুটে এসছে। সবার চোখে পানি। দরিদ্র কৃষক ফজলুর রহমানের তিন সন্তান। বড় মেয়ে আছমা বেগমের বিয়ে হয়েছে। তারপর ছেলে ফারুক। তাঁর ছোট বোন ফারজানা বেগম। তাঁরও বিয়ে হয়েছে।

ফারজানা ভাইয়ের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে চিত্কার দিয়ে বলছেন, ‘ও ভাই, তুমি কোথায়? আমাদের এমন কেন হলো?’

আর মা! ‘হামার বাবা কোটে হারে গেলরে। কোন্ দুষমন মোর বাবাক মারি ফেলে দিল। মোর বাবা গত মঙ্গলবার ট্যাকা লিয়ে গেল। আর কয়ে গেল আর এক বছর পড়লেই পড়া শেষ করে চাকরি করে গ্রামীণ ব্যাংকের লোন শোধ করমো। বাবার মুককোনা একনিই হামাক এ্যানা দেখাও।’ সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ফারুকের মায়ের বিলাপ শুনে প্রতিবেশীরাও কান্নায় ভেঙে পড়ছে।

ফারুকের সহপাঠী গ্রামের সুফল হোসেন জানান, ফারুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ২০০২ সালে ছোট মাঝিপাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে। তারপর জয়পুরহাট তালীমুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান (অনার্স) শ্রেণীতে ভর্তি হন। ক্লাস ওয়ান থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ফারুক কখনো দ্বিতীয় হননি।

সুফল বলেন, ‘সকাল নয়টার দিকে টেলিভিশনে ফারুকের মৃত্যুর খবর পাই। তারপর বাড়ি গিয়ে ফারুকের মাকে বলি, চাচি ফারুকের কোনো খবর পেয়েছেন? তখন পর্যন্ত তাঁরা কিছুই জানতে পারেননি। বেলা ১১টার দিকে তাঁরা মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন।’

ছোট মাঝিপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হযরত আলী জানান, ‘এ রকম একটি মেধাবী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খুন হবে, এটা ভাবা যায় না। দরিদ্র এই পরিবারটির এখন কী হবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।’


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন