ওয়াসেক বিল্লাহ্ | তারিখ: ১০-০২-২০১০
২০০০ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে মাইক্রোবাসে ব্রাশফায়ার করে ছাত্রলীগের আটজন নেতা-কর্মীকে হত্যা করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। এ ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কয়েকজন নেতার কারাদণ্ড হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংগঠনটি।
মূলত ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে শিবির। হত্যা, পায়ের রগ কেটে দেওয়াসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসের ঘটনায় বারবার শিরোনাম হয়েছে সংগঠনটি। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিবিরের আধিপত্য রয়েছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দখল করতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন শিবিরের ক্যাডাররা। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত জোট করার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের নিয়মিত সংঘর্ষ হতো।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করীম গতকাল প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। কোনো ঘটনায় কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুনের রাজনীতি: ১৯৮৮ সালের ৩১ মে শিবিরের হামলায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার ছাত্রমৈত্রীর নেতা জামিল আক্তার নিহত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের (রাকসু) সাবেক সহসভাপতি রাগিব আহসান প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের হিসাব অনুযায়ী ’৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাজশাহীতে শিবিরের হামলায় অন্য ছাত্রসংগঠনের অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। সারা দেশে এখন পর্যন্ত শিবিরের হাতে শুধু ছাত্রমৈত্রীর ছয়জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। এ ছাড়া ’৮৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জালাল নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেন ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা।
রাগিব হাসান জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ’৯০ সালের ২৪ ডিসেম্বর শিবিরের ক্যাডারদের হামলায় মারা যান ছাত্রমৈত্রীর নেতা ফারুকুজ্জামান। ২০০৪ সালে বরিশালে ছাত্রমৈত্রীর আরেকজন কর্মী নিহত হন শিবিরের ক্যাডারদের হামলায়।
২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহীর জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ওই মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন আসামির জবানবন্দিতেও খুনের ঘটনায় সালেহীর সম্পৃক্ততার কথা উঠে এসেছিল। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে সালেহী খালাস পেয়ে যান। ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সালেহীকে শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য করা হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আশির দশকে রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ করে ক্যাম্পাস দখল করে শিবির। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিএনপি সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের এক নেতাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও শিবিরের সম্পৃক্ততার জোরালো অভিযোগ ছিল। এ হত্যার বিচার চেয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিনের কাছে দাবিনামাও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিচার হয়নি।
সর্বশেষ গত সোমবার রাতে শিবিরের ক্যাডারদের হামলায় খুন হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন।
নানা সময়ে অস্ত্র উদ্ধার: চট্টগ্রামের আলোচিত শিবিরের ক্যাডার নাছির ’৯৭ সালে রাইফেলসহ ধরা পড়ে এখন কারাবন্দী। ২০০১ সালে শিবিরের ক্যাডার আহমুদ্যিয়া পক্ষ ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যান। আহমুদ্যিয়া চট্টগ্রাম-১৪ আসনে জামায়াতের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীর ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
গত ১৮ জানুয়ারি রাতে চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং এলাকার মিস্ত্রিপাড়ার ‘হক ভিলা’ নামের শিবিরের একটি মেস থেকে পুলিশ চারটি রিভলবার, তিনটি এলজি, ৩৭টি গুলি, বোমা তৈরির পাউডার ও বেশ কিছু জিহাদি বই উদ্ধার করে। একটি পিস্তলের গায়ে ‘মেইড ইন পাকিস্তান’ লেখা ছিল।
এ ঘটনার পরদিন মেহেরপুরে শিবির-নিয়ন্ত্রিত ‘স্বপ্নায়ন’ ছাত্রাবাসের পুকুর থেকে একটি শাটারগান উদ্ধার করে পুলিশ। মেহেরপুর জেলা জামায়াতের আমির ছমির উদ্দিন দাবি করেন, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা সাজানো।
ধরা পড়লেই অস্বীকার: বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, যখনই শিবিরের কোনো নেতা অস্ত্রসহ ধরা পড়েছেন, প্রতিবারই সংগঠনটির পক্ষ থেকে দুই ধরনের বক্তব্য এসেছে। তারা হয় বলেছে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি তাদের সংগঠনের কেউ নয় অথবা বলেছে, এসব ঘটনা সাজানো।
১৯৯৭ সালে শিবিরের ক্যাডার নাছির অস্ত্রসহ ধরা পড়ার পর শিবির দাবি করে, নাছির তাদের সংগঠনের কেউ নন। শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে শিবিরের ক্যাডার আহমুদ্যিয়ার ছবিও আছে। তার পরও ২০০১ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর আহমুদ্যিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বেমালুম অস্বীকার করে বসে শিবির।
২০০০ সালে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের আটজন নেতা-কর্মীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় নিজ সংঠনের কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিবিরের সভাপতি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ওই কাজে তাঁদের সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছেন।
আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করলে সে তো দোষী হয়—এ বক্তব্যের জবাবে শিবিরের সভাপতি বলেন, ‘আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন। তারা আমাদের কেউ না।’ পরে তিনি বলেন, ‘এইট মার্ডারের ঘটনার সময় আমি কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলাম না। তার পরও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তারা আমাদের কর্মী ছিল না।’
শিবিরের নেতারা আজকাল যা বলছেন: সম্প্রতি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে শিবিরের বর্তমান ও সাবেক নেতারা বেশ আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন। গত ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে শিবিরের সভাপতি রেজাউল করীম বলেন, ‘পৃথিবীর সব অস্ত্র জোগাড় করেও শিবিরকে মোকাবিলা করা যাবে না।’
৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত আলোচনা সভায় শিবিরের সাবেক সভাপতি সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘ছাত্রশিবির একটি দুর্গ। এই দুর্গে আঘাত হানতে চাইলে পাল্টা আঘাতে আপনাদের দুর্গ চুরমার হয়ে যাবে।’ আরেক সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম শিবিরকে না ঘাঁটাতে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, শিবিরের কাজে বাধা দিলে পানির ১০ হাত নিচে গিয়েও কেউ বাঁচতে পারবে না।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন