
চট্টগ্রামের ডবলমুরিং এলাকায় ছাত্রশিবিরের মেস থেকে উদ্ধার করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলির কয়েকটি
ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং এলাকায় রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের মেস থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক এবং জিহাদি বই উদ্ধার করেছে। এ সময় জামায়াতের একজন সক্রিয় কর্মীসহ সংগঠনের ১২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিষিদ্ধঘোষিত হিযবুত তাহরিরের আস্তানা মনে করে পুলিশ গত রোববার দিবাগত রাত সোয়া একটা থেকে ওই মেসে অভিযান শুরু করে। গতকাল সোমবার সকাল সাতটা পর্যন্ত চলে অভিযান।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া ১২ জনের মধ্যে একরামুল হক (৬২) পেশায় চিকিত্সক। তিনি জামায়াতের সক্রিয় কর্মী। ওই ভবন থেকে একরামুল হকের ছেলে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র গোলাম আজম আব্বাসীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি ১০ জন হলেন—লুত্ফর রহমান, একরামুল হক, সৈয়দ আল আমিন মাহমুদ, জহিরউদ্দিন বাবর, মিজানুর রহমান, মনজুর আলম, মহিউদ্দিন, রকিবুল হোসাইন, জায়েদ মুনতাসির ও আরিফ হোসেন।
পুলিশ জানায়, ডবলমুরিং থানার মিস্ত্রিপাড়ার ‘হক ভিলা’ নামের একটি ভবনের তিনটি ফ্ল্যাটকে মেস বানিয়ে শিবিরের ৩০-৩৫ জন নেতা-কর্মী বসবাস করছে। ওই ভবনে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য ছিল। এরই ভিত্তিতে ডবলমুরিং জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এস এম তানভীর আরাফাতের নেতৃত্বে একদল পুলিশ রোববার রাতে অভিযান চালায়।
পুলিশ জানায়, অভিযান চলাকালে হক ভিলার দ্বিতীয় তলার দুটি ফ্ল্যাট থেকে তিনটি রিভলবার ও তিনটি এলজি এবং চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে একটি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয় নাইন এমএম পিস্তলের গুলিসহ ৩৭টি গুলি, বোমা তৈরির পাউডার ও বেশ কিছু জিহাদি বই। এর মধ্যে একটি পিস্তলের গায়ে ‘মেইড ইন পাকিস্তান’ লেখা রয়েছে। নাইন এমএম পিস্তলের গুলি পাওয়া গেলেও পিস্তল পাওয়া যায়নি। এ অস্ত্র সরিয়ে অন্য কোথাও রাখা হতে পারে বলে পুলিশ সন্দেহ করছে। কারণ নাইন এমএমের গুলি অন্য কোনো অস্ত্রে ব্যবহার সম্ভব নয়।
উদ্ধার করা বইয়ের মধ্যে রয়েছে—দিনবদলের সনদ কি মানুষ হত্যার লাইসেন্স?, বাংলাদেশ ছাত্রশিবির—ব্যক্তিগত রিপোর্ট, আবুল আসাদের লেখা সংঘাতের মুখে ইসলাম, শামসুল হকের লেখা বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম, আবদুর রহিমের লেখা অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম, মুহাম্মদ নুরুল হকের লেখা জিহাদের ময়দানে মুসলিম বাহিনী। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক প্রকাশনা থেকে এসব বই প্রকাশিত হয়।
উপপুলিশ কমিশনার (বন্দর) কুসুম দেওয়ান প্রথম আলোকে জানান, এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুল আলম মোল্লা বাদী হয়ে সোমবার ১২ জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা করেন। এদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশ সদর দপ্তরকে তথ্য দেয়, আগ্রাবাদের মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় হিযবুত তাহরিরের গোপন আস্তানা রয়েছে। এখানে তাদের সঙ্গে শিবিরের একটি বৈঠক হতে পারে। সদর দপ্তরের এআইজি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ১১ জানুয়ারি এক চিঠিতে বিষয়টি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশকে জানায়। এর পরই নগর পুলিশ নজরদারি জোরদার করে। পুলিশের সন্দেহ ছিল, মিস্ত্রিপাড়ার এ মেসের সদস্যদের সঙ্গে হিযবুত তাহরিরের গোপন যোগাযোগ থাকতে পারে।
পুলিশের সহকারী কমিশনার তানভির আরাফাত বলেন, ‘পাঁচ দিন আগেই আমরা অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করি। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের ক্রিকেট টেস্টের কারণে অভিযান পিছিয়ে রোববার দিবাগত রাত ঠিক করা হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হক ভিলা চার গন্ডা (প্রায় পাঁচ কাঠা) জমির ওপর নির্মিত। বাড়ির দুজন মালিকের একজন শিবিরের সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের বর্তমান সহসাধারণ সম্পাদক আ জ ম ওবায়দুল্লাহ এবং অন্যজন ডা. একরামুল হক। নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে স্পাইন ইলেমেন্টারি স্কুল। নিচতলার আরেকটি এবং দ্বিতীয় তলার দুটি ফ্ল্যাটকে মেস বানিয়ে শিবিরের নেতা-কর্মীরা বসবাস করছে। ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলার মালিক ওবায়দুল্লাহ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ তলার মালিক ডা. একরাম।
সহকারী কমিশনার তানভীর বলেন, ‘ডা. একরামের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে রিভলবার এমনভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, যা সহজে কারও নজরে পড়ার কথা নয়। তল্লাশি চালাতে চালাতে আমরা ওয়াশিং মেশিনের ছোট চেম্বারে ফোমের নিচে রিভলবারটি পাই।’ অবশ্য ডা. একরাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, পুলিশ তাঁর বাসায় কোনো অস্ত্র পায়নি। দ্বিতীয় তলার মেস থেকে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তার শিবিরকর্মীরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, এসব অস্ত্র তাঁদের বড় ভাইদের। তবে পরে প্রথম আলোর কাছে তাঁরা দাবি করেন, এসব অস্ত্রের মালিক কারা, তাঁরা তা জানেন না।
শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, আগে থেকে অস্ত্র রেখে শিবিরের দুর্নাম করার জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে। ঢাকায় বসে আপনি বিষয়টি জানলেন কীভাবে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর নিয়ে এ তথ্য পেয়েছি। আমরা আরও খোঁজখবর নিচ্ছি।’
ওবায়দুল্লাহ যা বলেন: শিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের কারণে ঢাকায় আছেন বাড়ির নিচ ও দ্বিতীয় তলার মালিক ওবায়দুল্লাহ। তবে তিনি দাবি করেন, ‘এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার নামের একটি ট্রাস্টের জন্য গত বছর চারতলা ভবনটি কেনা হয়। নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা ট্রাস্টের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান আমি। আর তৃতীয় ও চতুর্থ তলার মালিক ডা. একরাম। তিনি ট্রাস্টের চেয়ারম্যান।’ তিনি দাবি করেন, পুলিশের অভিযান সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক। পুলিশ রাত আড়াইটায় নিরীহ ছাত্রদের ঘুমের মধ্যে গিয়ে ধরেছে।
মিস্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা জহিরউদ্দিন জানান, হক ভিলা জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ওই ভবনে অচেনা লোকজনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এলাকার লোকজন ভয়ে এ নিয়ে কথা বলার সাহস পেত না।
বিক্ষোভ সমাবেশ: ১১ নেতা-কর্মী এবং একজন চিকিত্সককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্রশিবির গতকাল নগরে বিক্ষোভ মিছিল করে। মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের সামনে থেকে একটি মিছিল বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক ঘুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে শিবির নেতাদের মুক্তি দাবি করেন। তাঁরা প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলেন, প্রথম আলো ছাত্রশিবির ও এ দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করছে।
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন