নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম | তারিখ: ২৫-১০-২০০৯
আধিপত্য বিস্তার এবং নতুন ছাত্রদের পক্ষে টানার জের ধরে গতকাল শনিবার সকাল থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষও তা জানত। এ জন্য দুপুর দুইটার দিকে মেডিকেল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতেও শেষরক্ষা হয়নি।
ছাত্রলীগ ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পুড়েছে প্রধান ছাত্রাবাসের ১১টি কক্ষ। ভাঙচুর হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি কক্ষ। পরে কলেজ ক্যাম্পাসের অদূরে চকবাজার মোড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুই ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। সংঘর্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ছাত্রাবাস ও মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন আছে।
কর্তৃপক্ষ মেডিকেল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করার পর গতকাল রাত আটটার মধ্যে ছাত্রাবাস এবং আজ রোববার সকাল আটটার মধ্যে ছাত্রীনিবাস থেকে শিক্ষার্থীদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ গোফরানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছি। তবে ভর্তি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল সকাল থেকে এমবিবিএস কোর্সে প্রথম বর্ষে ভর্তি শুরু হয়। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নতুন শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়ে ছাত্রলীগ ও শিবির পৃথক মিছিল বের করে। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে তা মিটমাট হয়ে গেলেও এ নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানায়, দুপুরের ঘটনার জের ধরে গতকাল বিকেল পৌনে চারটার দিকে কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে শাসক দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্যে আবার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় শিবিরের নেতা-কর্মীরা প্রথমে ছাত্রাবাসের সি ব্লকে ছাত্রলীগের সদস্যদের কয়েকটি কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। পরে ছাত্রলীগও পাল্টা ভাঙচুর ও মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রাম কলেজের আবদুস সবুর হোস্টেল থেকে বহিরাগত যুবকেরা মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসের বাইরে অবস্থান নেন। বহিরাগত ওই যুবকেরা হোস্টেল লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। তাঁরা শিবিরের সমর্থক বলে উপস্থিত লোকজন অভিযোগ করে।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে ঢুকে লাঠিপেটা করতে থাকে। পরে পুলিশের পাহারায় শিবিরের নেতা-কর্মীরা ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে অবস্থান করা বহিরাগত যুবকদের সঙ্গে মিলে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সময় পুলিশ তাঁদের ধাওয়া দেয়। পরে পুলিশ টিয়ার সেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে শিবিরের কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এদিকে শিবির পুলিশের পাহারায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ শিবিরের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় কয়েকটি কম্পিউটার ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলেও ছাত্রলীগের বাধার কারণে প্রথম দফায় ঢুকতে পারেনি। ছাত্রলীগ এ সময় পুলিশের মারধরের প্রতিবাদ জানায়।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের দেওয়া আগুনে ছাত্রাবাসের ১১টি কক্ষ পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের চারটি গাড়ি সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশ সূত্র জানায়, সংঘর্ষে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা হলেন তন্ময় (২০), মামুন (২০), ফুয়াদ (২০), সানি (২১), আসিফ (২৩), রাজীব (২২) ও পারভেজ (২৫)। তাঁরা সবাই মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য বলে জানা গেছে। আহত পুলিশ সদস্য হলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়েছেন।
মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ নাছিফ বলেন, ‘শিবির আচমকা হামলা করলে আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা আহত হন। পরে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। এ সময় শিবির ছাত্রাবাসের ২০-২৫টি কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে পুলিশও আমাদের ওপর চড়াও হয়।’
মেডিকেল কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রলীগ পুলিশের সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে। তারা আমাদের ২০টি কক্ষ পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় আমাদের পাঁচজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। আমাদের হামলায় ওদের কেউ আহত হয়নি।’
এদিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া ছাত্রশিবিরের কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে চট্টেশ্বরী সড়ক হয়ে চকবাজারের দিকে মিছিল করে চলে যেতে থাকেন। এ সময় চকবাজার অলি খাঁ মসজিদের সামনে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পূর্বনির্ধারিত একটি সভা চলছিল। শিবিরের কর্মীরা বিকেল পাঁচটার দিকে ওই সভায় হামলা চালিয়ে মঞ্চ, চেয়ার ও মাইক ভাঙচুর করেন এবং নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকেন। এ সময় যুবলীগের ওয়ার্ড সভাপতি মো. একরাম হোসেনসহ কয়েকজন আহত হন।
একরাম হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ফজলে নূর তাপসের ওপর বোমা হামলার প্রতিবাদে পূর্বনির্ধারিত সভা করছিলাম। শিবিরের ক্যাডাররা আচমকা হামলা চালিয়ে আমাদের সভা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে আমিসহ অন্তত পাঁচজন আহত হই।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আচমকা হামলার পর চকবাজার মোড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে শিবিরের কর্মীদের ধাওয়া করেন। ধাওয়া খেয়ে তাঁরা চট্টগ্রাম কলেজসংলগ্ন প্যারেড ময়দানের কাছে অবস্থান নেন। এরপর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সমর্থকদের সঙ্গে তাঁরা ইটপাটকেল বিনিময় করতে থাকেন। এ সময় গুলজার টাওয়ারসহ চকবাজার এলাকার কয়েকটি দোকান ভাঙচুর হয়। সংঘর্ষে যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যার দিকে র্যাব-পুলিশের হস্তক্ষেপে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) বনজ কুমার মজুমদার এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে দুটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনব।’
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন