| তারিখ: ১৪-১২-২০১০
[১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শোয়েব আহমেদ গত ৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সাক্ষী হিসেবে দেওয়া তাঁর এ জবানবন্দি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো—]
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল অবৈধ অস্ত্র আটক করার সময় আমি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। ২ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমাকে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান ফোন করেন। তিনি জানান, গত রাতে চট্টগ্রাম সিইউএফএল ঘাটে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র আটক হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের লোকজন সেগুলো ঘিরে রেখেছে। সেখানে তারা কাউকে যেতে দিচ্ছে না। সিইউএফএলের এমডি আমাকে ফোনে এসব জানিয়েছেন।’
আমি জিজ্ঞেস করি, ওখানে কি সিইউএফএলের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন উপস্থিত ছিল না? তাঁদের উপস্থিতিতে সেখানে অবৈধ অস্ত্রের ট্রলার কীভাবে ভিড়ল? আর কীভাবেই সে অস্ত্র আনলোড হলো? জবাবে
ইমামুজ্জামান বললেন, ‘এটা তো আমারও প্রশ্ন।’
আমি তাঁকে নির্দেশনা দিই, বিসিআইসির চেয়ারম্যান হিসেবে সিইউএফএলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা ও শৈথল্য আছে কি না, তা নিরূপণ করতে হবে। ... প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর আপনি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন। ...
আমি ইমামুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করি, এ বিষয় আপনি আর কাকে জানিয়েছেন? তিনি জবাব দেন, ‘আমি মন্ত্রী মহোদয়কেও বিষয়টি জানিয়েছি।’...
৪ এপ্রিল (২০০৪) সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে আমি অফিসে যাই। সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টায় আমি শিল্পমন্ত্রী (মতিউর রহমান নিজামী) মহোদয়ের কক্ষে যাই। আমি নিজেই আলাপ শুরু করি। আমি বলি, শুক্রবার ইমামুজ্জামান সাহেব ফোন করেছিলেন। তিনি আমাকে সিইউএফএল ঘাটে অস্ত্র আটকের ব্যাপারে জানিয়েছেন। আমার কথা শেষ করতে না করতেই তিনি (নিজামী) বলেন, ‘আমি এ বিষয় সবকিছু অবগত আছি।’
আমি মন্ত্রীকে বলি, আমি ইমামুজ্জামান সাহেবকে নির্দেশ দিয়েছি সিইউএফএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তাঁকে এটাও নির্দেশ দিয়েছি, যেন গৃহীত ব্যবস্থা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেন। আজ ইমামুজ্জামান সাহেব আসবেন এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানাবেন।
মন্ত্রী মহোদয় আমাকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি অ্যাকশনে নেমেছে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সিইউএফএলের কেউ জড়িত কি না, তা তারাই বের করতে পারবে। শিল্প মন্ত্রণালয়কে আলাদাভাবে কিছু করতে হবে না।’
তখন আমি বলি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে খবরগুলো দেখেছি, তাতে শিল্প মন্ত্রণলয়কে জড়িয়ে খবর পরিবেশিত হয়েছে। এই বিষয়ে আমাদের অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ জন্যই আমি বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছি ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে। আমি মনে করি, তা দরকার আছে।
এ পর্যায়ে শিল্পমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের হাইয়েস্ট অথরিটিও (সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ) এ বিষয়ে অবগত আছেন। সরকার সব ব্যবস্থা নিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি কি মনে করেন আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি নাই?’
শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপের সময় বলি, বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে ঘটনার রাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন সিইউএফএলের রেস্টহাউসে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সেখানে অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তিনি কবে, কখন এই ট্যুর প্রোগ্রাম করেন, তাও আমি জানি না। ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে তিনি কীভাবে ট্যুর প্রোগ্রাম করলেন, তাও বুঝতে পারলাম না।
তখন মন্ত্রী বলেন, ‘আপনি তো সরকারি কাজে বেশ কিছুদিন বিদেশে ছিলেন, এ সময় অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিন সাহেবই তো সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। সেভাবেই হয়তো তিনি এ ট্যুরে গিয়ে থাকবেন।’
আমি বললাম, আজ রোববার, তিনি এখনো ফেরেননি। সিইউএফএলের এত বড় ঘটনা সম্পর্কে তিনি ঘটনাস্থলে অবস্থান করা সত্ত্বেও কিছুই জানাননি। একটা ফোন পর্যন্ত করেননি। আমি অফিসে এসে শুনলাম, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে সিইউএফএল থেকে কক্সবাজার চলে গেছেন।
মন্ত্রী মহোদয় বলেন, ‘এটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
আমি বলেছি, এত বড় একটা ঘটনার সময় তাঁর সেখানে অবস্থান এবং কিছু না জানানোটা যথার্থ মনে করি না। এর জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’
এরপর আমি আমার কক্ষে চলে যাই। আধা ঘণ্টা পর মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান আমার দপ্তরে আসেন। তিনি জানান, ‘স্যার সিইউএফএলের এমডিকে সামগ্রিক বিষয়ে একটি রিপোর্ট জরুরি ভিত্তিতে প্রদান করতে বলেছি।’
আমি জানতে চাই, এ রিপোর্ট কবে নাগাদ পাবেন? তিনি বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠাতে বলেছি।’
এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। কারণ তিনি আমাকে আলাদাভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেননি। এটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি ইমামুজ্জামানকে তখনি মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিই। ভেবেছিলাম, হয়তো তিনি বুঝিয়ে বললে মন্ত্রী ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।
প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর ইমামুজ্জামান আমার কক্ষে ফিরে এসে বলেন, ‘মন্ত্রীকে অনেক বোঝালাম। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাজ করছে বিধায়, মন্ত্রী মহোদয় আলাদা কোনো ব্যবস্থা নিতে মানা করেছেন।’
বুঝতে পারলাম মন্ত্রী আমাকে যা বলেছেন, তাঁকেও তাই বলেছেন।
তিন-চার দিন পর ইমামুজ্জামান আমাকে ফোন করে জানান, সিইউএফএল থেকে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। রিপোর্টে অস্ত্র আটক বিষয়ে কিছুই বলা নেই। সে রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর মতো নয়। এই রিপোর্ট অত্যন্ত দায়সারা গোছের।
অস্ত্র আটকের পরে ১৫-২০ দিন অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিনের সঙ্গে আমার কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি যে ঢাকায় ফেরেন, তাও জানতে পারিনি। তিনি এমনিতেই আমার কক্ষে খুব একটা আসতেন না। একটা স্পর্শকাতর ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়ে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছিল, আর ঘটনার সময় তিনি সিইউএফএলে অবস্থান করছিলেন, অথচ সে ব্যাপারে তিনি আমার কাছে তাঁর কোনো অবস্থান ব্যাখ্যা করেননি। তিনি যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করেছেন, সেটাও আমার জানা নেই। ...তিনি মন্ত্রীর (নিজামী) অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। মন্ত্রীই তাঁকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন। তিনি মূলত রেলওয়ের ক্যাডারের। ...
অস্ত্র আটকের পর মে ও জুন মাসে আমি কয়েকটি দেশ সফর করি সরকারি কাজে। জুন মাসে (২০০৪) ইন্দোনেশিয়া থেকে ফেরার পর একদিন আলাপের সময় শিল্পমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম সরকার এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা তাদের কার্যক্রমও গ্রহণ করেছে। আমি তো মনে করি, সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থাই নিয়েছে।’
আমি বিনীতভাবে বললাম, আমি এখনো মনে করি বিসিআইসির পক্ষ থেকে যা করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। তার ফলে শিল্প মন্ত্রণালয়ও এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারছে না। প্রতি-উত্তরে কিছুটা বিরক্তির স্বরে তিনি (নিজামী) বলেন, ‘দেশের সরকার তো একটাই। আলাদা আলাদাভাবে এখানে কী করার আছে?’
এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রীর সঙ্গে আমার এ বিষয়ে আর কোনো আলাপ হয়নি। আমার মনে হয়েছিল, তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপছন্দ করেন। ২৮ জুলাই (২০০৪) আমাকে অপ্রত্যাশিতভাবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। ...বদলির সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ে আমার চাকরির মেয়াদ ছিল মাত্র ১০ মাসের। ...
অস্ত্র আটকের পর যে তিন মাস আমি শিল্প মন্ত্রণালয়ে ছিলাম, সেই তিন মাসে আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার, কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা হচ্ছে।
শিল্পমন্ত্রীর কথাবার্তা ও অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিনের রহস্যজনক আচরণ দেখে মনে হয়েছে, পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ...
সিইউএফএল জেটি কেবল ওই সার কারখানার কাজেই ব্যবহূত হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অবৈধ অস্ত্রবাহী ট্রলার সিইউএফএলের জেটিতে কীভাবে ভিড়ল, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও খুঁজে পাইনি। সেটা আমার কাছে এখনো রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
এই আমার জবানবন্দি। আমি স্বেচ্ছায় এ বক্তব্য প্রদান করলাম।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন