6 October 2010

নিজামীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হচ্ছেন লুৎফর রাজাকার

নিজস্ব প্রতিবেদক ও বেড়া (পাবনা) প্রতিনিধি

জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হচ্ছেন পাবনার লুৎফর রাজাকার (লুৎফর রহমান)। একাত্তরে নিজামীর দোসর ও পাবনা এলাকার রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন লুৎফর রাজাকার। তবে তিনি নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি বলেছেন, বিষয়টি টের পেয়ে তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে পাবনা জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

গত বুধবার পাবনার বেড়া উপজেলার নিজের বাড়িতে বসে লুৎফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, '১৯৭১ সালে আমি যে ভুল করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে আমি যে পাপ করেছি, তা থেকে মুক্ত হতে চাই। আর এ জন্যই মতিউর রহমান নিজামীর অপকর্ম আদালতের কাছে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মতিউর রহমান নিজামী আমাদের দল রাজাকার বাহিনীর নেতা। আমি তাঁর দলের সদস্য হয়ে ১৯৭১ সালে নানা অপরাধ করার কারণে ১১ মাস জেল খেটেছি। সেই সব অপরাধের নেপথ্যে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।' লুৎফর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'রাজাকার হওয়ায় আমার শাস্তি হলো, কিন্তু মতিউর রহমান নিজামীর শাস্তি হবে না, এটা তো হতে পারে না।'

নিজের বাড়িতে বসে কালের কণ্ঠের কাছে এ কথাগুলো বলার পর লুৎফর রহমান সেদিন আর কিছু বলতে রাজি হননি। নিজের নিরাপত্তা এবং একই সঙ্গে তদন্তকাজে সমস্যা হতে পারে_এ যুক্তি দিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। কিন্তু পরের দিন এ প্রতিবেদকদের ডেকে নেন বেড়া উপজেলার জোড়গাঁথা বাজারে। সেখানে তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কী কী ভূমিকা ছিল, কাদের প্ররোচনায় তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন_সব খুলে বলেন। তিনি উদ্বেগের সঙ্গে জানান, নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।

লুৎফর রাজাকার বলেন, '১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামীর প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেই। মাসে বেতন ছিল ১৩০ টাকা। তিন মাস ট্রেনিং নেই। এরপর নেমে পড়ি অভিযানে। পাবনার পথে-প্রান্তরে নানা অপরাধ করেছি। পরিকল্পনা করে নানা অভিযানে অংশ নিয়েছি। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী যে ধরনের কাজ করেছে, আমিও সেসব করেছি। এসব কিছুর নেপথ্যে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।'

কেন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'মতিউর রহমান নিজামীর প্ররোচনায় এবং বখে যাওয়া কিছু বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। বয়সেরও একটা দোষ ছিল। ভুল পথে গিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে চেয়েছি। আমার সমবয়সীরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে আর আমি রাজাকার হলাম, এর দায় আমি বয়সের দোষ দিয়ে অবশ্য এড়াতে পারি না। জীবনের তিন কাল পাড়ি দিয়ে শেষ কালে এসেছি। মৃত্যুর আগে নিজের কৃতকর্মের মাফ নিয়ে মরতে চাই।'

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আপনি কি কোনো হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন বা কাউকে ধর্ষণ করেছেন_এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে লুৎফর রাজাকার বলেন, 'রাজাকাররা যা করেছে, আমিও তা করেছি। তবে আমি নিজে এসবে অংশ নেইনি।' কখন তিনি ভুল বুঝতে পারেন জানতে চাইলে লুৎফর রাজাকার বলেন, '১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই আমি আমার ভুল উপলব্ধি করেছি। যুদ্ধের পর জেলে না গেলে আমি আজ বাঁচতে পারতাম না। পাবনা জেলখানাই আমাকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছিল।'

নিজামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের জন্য কী কী তথ্য আপনাদের হাতে রয়েছে_জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, যা দিয়ে নিঃসন্দেহে তাঁর যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ করা যাবে। আমি রাজাকার ছিলাম, আমি জানি নিজামী কতটা ভয়াবহ। তাঁর পক্ষে কী করা সম্ভব। আমার কাছে এমন তথ্য-প্রমাণ আছে, যা আর কারো কাছে নেই। সেই তথ্য-প্রমাণ রাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।' সেই তথ্য-প্রমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধ তদন্তদল আসছে। তাদের কাছেই সব বলব। এ মুহূর্তে সেসব প্রকাশ পেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে তদন্তদলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে নিষেধ করেছে।'

তবে লুৎফর রাজাকার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ছাত্রশিবিরের নেতারা তাঁকে হুমকি দিয়েছে। প্রথমে তারা বোঝাতে চেয়েছে, নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে বিষয়টি ধর্মের বিরুদ্ধে যাবে। পরে তারা সরাসরি হুমকি দিয়েছে। লুৎফর রহমান বলেন, 'ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ জন আমাকে হুমকি দিয়েছে। তাদের কেউ এসে সরাসরি, কেউ বা মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়েছে। অনেকে পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে গেছে।' তিনি আরো বলেন, 'নিজের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি। কারণ তারা কতটা নৃশংস হতে পারে, তা আমি কাছে থেকে দেখেছি। এর প্রমাণ দেশবাসীও ১৯৭১ সালে দেখেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা থেমে নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রগকাটা রাজনীতি দেখেও কি তাদের রাজনীতি বুঝতে কারো কষ্ট হয়?' এ কথা বলে আবেগসিক্ত হয়ে পড়েন লুৎফর রাজাকার।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন