2 August 2010

ঢাকায় জঙ্গিঘাঁটির খোঁজে: ভাড়াটিয়া ও হোটেল বোর্ডারদের তথ্য সংগ্রহসহ বিশেষ পরিকল্পনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে জঙ্গিদের আস্তানাগুলো চিহ্নিত করতে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে তাদের ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তথ্য, আবাসিক হোটেলে অবস্থানকারী বা বোর্ডারদের তথ্য এবং বিদেশি নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহসহ ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর থেকে থেকে ১৩ দফা বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে মহানগরের আটটি বিভাগ ও গোয়েন্দা পুলিশের কাছে এই নির্দেশনা পেঁৗছেছে। নির্দেশনা হাতে পেয়ে পুলিশ কাজও শুরু করেছে। হ্যান্ডবিল ছাপানোর কাজ করছে পুলিশ। এ হ্যান্ডবিল বাড়িওয়ালাদের কাছে পাঠানো ছাড়াও পথচারীদের মধ্যে বিলি করা হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এর আগেও রাজধানীতে বাড়ির মালিকদের কাছে এ রকম চিঠি পাঠানো হয়েছিল। বাড়িওয়ালাদের প্রতি নির্দেশ ছিল ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে তথ্য, যেমন ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করে নিকটস্থ থানা পুলিশকে অবহিত করার। পরে সে উদ্যোগে ভাটা পড়ে যায়। এই সুযোগে জঙ্গিরা রাজধানীতে ঘাঁটি বা আস্তানা গড়ে তোলে। গত দুই মাসের ব্যবধানে রাজধানীতে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ।

গত শুক্রবার শাহআলী থানা এলাকার আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। মে মাসে কদমতলীর পূর্ব জুরাইনের জেএমবির আরেকটি শক্তিশালী ঘাঁটির সন্ধান পায় পুলিশ। ওই ঘাঁটিতে অভিযানকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছিল জঙ্গিদের। এর আগে শেওড়াপাড়ার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও গ্রেনেডসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মিজান ওরফে বোমারু মিজান। পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের এ রকম আরো অনেক ঘাঁটি রাজধানীতে আছে। বাড়িওয়ালারা সচেতন হলে জঙ্গিরা ঘাঁটি গাড়তে সাহস পাবে না।

শুক্রবার উদ্ধার করা অস্ত্র ও বিস্ফোরক সম্পর্কে শাহআলী থানার ওসি আবদুল লতিফ জানান, বাড়ির মালিক ওই ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে কোনো তথ্য না নিয়েই বাড়ি ভাড়া দেন। চার জঙ্গি দাড়ি না রেখে ছদ্মবেশে চলাফেরা করত। মালিক তথ্য নিয়ে ভাড়া দিতে চাইলে তারা হয়তো ওই বাড়িতে আসার সুযোগ পেত না। তবে এ-সংক্রান্ত আইন না থাকায় পুলিশকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। আপাতত কমিউনিটি বা বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই কাজ করবে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর দপ্তর) হাবিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকরা পুলিশের নির্দেশনা মানছেন না। বাড়ির মালিকদের প্রতি আগের নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য পুলিশ কাজ শুরু করেছে। রাজধানীর আটটি বিভাগের উপকমিশনারকে এবং সব থানায় বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে। থানা পুলিশ বাড়ির মালিকদের কাছে গিয়ে ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করবে। এরপর কোনো জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিললে ওই বাড়ির মালিককেই দায়িত্ব বহন করতে হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১৩ দফা নির্দেশনায় জঙ্গি, চরমপন্থী বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে বাড়ির মালিক ছাড়াও কমিউনিটি পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে পুলিশকে। এতে আরো বলা হয়, রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলে জঙ্গিদের অবস্থান করার আশঙ্কা আছে। তাই হোটেলগুলো 'হোটেলে অবস্থানকারী বৃত্তান্ত ফরম' যথাযথভাবে পূরণসহ বোর্ডার রেজিস্টার সংরক্ষণ করছে কি না তা তদারক করতে হবে। ঢাকায় যাতে জঙ্গিরা ঢুকতে না পারে সে জন্য রাজধানীর সব কয়টি প্রবেশপথে বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও লঞ্চঘাটে চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহজনক যানবাহনে সতর্কতার সঙ্গে বিধি মোতাবেক তল্লাশি চালানোর নির্দেশ রয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা ব্যক্তির কার্যালয় ও বাসভবনে নিরাপত্তা জোরদার, সন্দেহজনক গাড়ি পার্কিং, ভ্রাম্যমাণ দোকান, ভিক্ষুক বা অন্য ছদ্মবেশ ধারণকারী ব্যক্তি, হকার, ফেরিওয়ালাদের সন্দেহজনক মনে হলে তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে পুলিশকে। এতে আরো বলা হয়, রাজধানীতে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিশেষ নিরাপত্তা ও নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জনসচেতনতার দিকে। এ লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশের মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিয়ম করতে হবে।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ কালের কণ্ঠকে জানান, উত্তরা এলাকায় বাড়িওয়ালাদের কাছে বিদেশি নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখন একটি হ্যান্ডবিল ছাপা হচ্ছে, যা দু-এক দিনের মধ্যে প্রত্যেক বাড়ির মালিকের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হবে। হ্যান্ডবিলে জঙ্গি ও অপরাধ রোধে বাড়ির মালিকদের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। উত্তরা এলাকায় সেক্টর কল্যাণ সমিতি, থানা পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশ এই চিঠি ও হ্যান্ডবিল পেঁৗছানোর দায়িত্ব পালন করবে। কোনো বাড়িতে বিদেশি নাগরিক থাকলে তার ছবি, পাসপোর্ট নম্বর, ভিসার ফটোকপি, কী উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আছে_এসবের তথ্য রাখার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি নাগরিক সম্পর্কে ভালো জানেন এমন তিনজনের সাক্ষ্য নিয়ে সেই তথ্য পুলিশকে জানাতে বলা হয়।

উত্তরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবদুল্লা আল মামুন বলেন, 'বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে উত্তরা ও তুরাগ থানা এলাকার বাড়ির মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার তুরাগের রানা ভোলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির মালিকরা এসব তথ্য সংরক্ষণ করছেন। আমাদের ইচ্ছা আছে সব বাড়িওয়ালার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কম্পিউটারাইজড করে রাখা।'

হকারের আড়ালে জঙ্গি
রাজধানীর শাহআলী এলাকার ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা বিস্ফোরক ও অস্ত্রের মালিক চার জেএমবি সদস্য। তাদের গ্রেপ্তার করতে র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক টিম ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অভিযান চালাচ্ছে।

মিরপুর জোনের উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে জানান, পালিয়ে যাওয়া ওই চার জঙ্গির বাড়ি বরিশাল জেলায় বলে জানা গেলেও নাম-পরিচয় জানা যায়নি। প্রাথমিক তদন্ত শেষে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি আরো জানান, জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে। উত্তর বিশিলের ওই বাড়িতে গ্রেনেড তৈরি করে হয়তো বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নিচ্ছিল জঙ্গিরা।

গোয়েন্দা পুলিশের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সহকারী কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে জানান, বড় ধরনের নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যেই ৮০ কেজি বিস্ফোরক মজুদ করেছিল জঙ্গিরা। যে গান পাউডার উদ্ধার করা হয়েছে তা দিয়ে শক্তিশালী বোমা তৈরি করা সম্ভব। গ্রেনেডটি খুবই শক্তিশালী। ওই বাসার জঙ্গিরা লাইটারে গ্যাস ভরার কাজ করত। মিরপুর এলাকায় ফুটপাতে তাদের দোকান ছিল।

শাহআলী থানার ওসি আবদুল লতিফ জানান, চার যুবক ওই বাসায় কখন ঢুকত, কখন বের হতো তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না। তাদের দৃশ্যমান পেশা ছিল হকারি করা।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন