7 July 2010

জামায়াতের লক্ষ্য ইসলামী কোয়ালিশন সরকার: রিমান্ডে সেই ভিডিও দেখে ঘামতে থাকেন নিজামী

মাসুদ কার্জন

ভবিষ্যতে বাংলাদেশে 'ইসলামী কোয়ালিশন সরকার' ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এ ধারণা মাথায় রেখেই তাদের দল সব কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গি বা ছোট ছোট ইসলামী দলকে তাদের অর্থ সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যও তাই। তাদের ধারণা, ছোট ছোট এসব ইসলামী বা জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেলে চূড়ান্তভাবে জামায়াতেরই লাভ। কারণ তাদের সবার লক্ষ্য এক। জামায়াতের ধারণা, সময়ের বিবর্তনে এসব জঙ্গি বা ছোট ছোট ইসলামী দল তাদের 'এক ছাতা'র নিচেই আসতে বাধ্য। জামায়াতের শীর্ষ তিন নেতাকে গতকাল মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

এদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধের দায় স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। পাশাপাশি তিন শীর্ষ নেতা দাবি করেছেন, বাংলাদেশে জামায়াতের অর্থনৈতিক ভিত অনেক শক্ত। তাদের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হয়। এর মধ্য থেকে বছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে শুধু জামায়াতে ইসলামীর জন্য। এ টাকা দলের বিভিন্ন খাতে খরচ হয়। এ ছাড়া 'স্বাস্থ্য বিভাগ' নামে জামায়াতের বিশাল প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী থাকার কথাও স্বীকার করেছেন তাঁরা।

পল্টন থানার অপারেশন অফিসার শাহাজালাল গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা, ভাঙচুর এবং রাষ্ট্রপতির গাড়িবহরে হামলা, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঘটনায় পৃথক দুটি মামলায় জামায়াতের তিন নেতাকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মুজাহিদ ও জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গত জুন মাসে পল্টনে পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা আরেকটি মামলায় আজ বুধবার আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। অন্যদিকে দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহরে হামলা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

পুলিশ সূত্র জানায়, জামায়াতের তিন নেতাকে কখনো পৃথকভাবে আবার কখনো পাশাপাশি বসিয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য আরেকজনের কাছে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মামলা ছাড়াও দেশে জঙ্গি তৎপরতা ও এর উত্থান, যুদ্ধাপরাধ এবং এর বিচার বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াতের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়েও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তিনজনের মধ্যে নিজামী অনেক কম কথা বলেন। কিছু জানতে চাইলে স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করতে চান না তিনি। প্রশ্নের উত্তরে অনেক সময় জানা নেই, খেয়াল নেই_এ ধরনের কথা বলে উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। গতকাল প্রথমে নিজামীকে নিজের সম্পর্কে বলতে বলেন জিজ্ঞাসাবাদকারীরা। এ সময় তিনি জানান, বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষা বলতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত, পরে তিনি মাদ্রাসা লাইনে পড়েছেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে জামায়াতে চলে আসেন। স্বাধীনতার পর প্রকাশ্যে জামায়াতের রাজনীতি করা না গেলেও তাঁদের দলের তৎপরতা থেমে থাকেনি। ওই সময় তাঁরা কর্মী বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে গোপনে কাজ করেছেন। জিয়াউর রহমানের সরকার আসায় তাঁরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়া হয় নিজামীর কাছে। যথারীতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। একপর্যায়ে শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে অস্ত্র খালাসের সময় ওই মন্ত্রণালয়ের সচিবের চট্টগ্রামে রহস্যজনক উপস্থিতির কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি নীরব হয়ে যান। পরে জেএমবি বা জঙ্গি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানতে চাওয়া হলেও তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদকারীরা সাইদুর ও বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিডিও ক্লিপিংস তাঁর সামনে তুলে ধরেন। সূত্র জানায়, এসব ভিডিও দেখে ঘামতে শুরু করেন নিজামী। পরে কিছুক্ষণের জন্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ রাখা হয়।

এদিকে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন, এ জন্যই দলের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা অনেক কমে গেছে। পরে তাঁর কাছে জামায়াতের স্বাস্থ্য বিভাগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনিই পদাধিকার বলে এ বিভাগের প্রধান। প্রথমে এ রকম বিভাগ থাকার কথা বেমালুম চেপে যান তিনি। পরে উপস্থাপন করা হয় সাবেক জামায়াত নেতা সাইদুরের স্বীকারোক্তির ভিডিও ক্লিপিংস। তখন কিছু তথ্য দেন তিনি। একসময় জামায়াতের এ বিভাগটির নাম ছিল তালিম বিভাগ। পরে জানাজানি হতে শুরু করলে ১৯৯৪ সালে নাম বদলে 'স্বাস্থ্য বিভাগ' করা হয়।

সূত্রমতে, জামায়াতের এ বিভাগের প্রত্যেককে শারীরিক কসরতের নামে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রথমে সিলেটের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভাগটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। পরে পর্যায়ক্রমে তা দেশের সীমান্ত ও পাহাড়ি এলাকায় বিস্তার ঘটে। ফলে অনেক সীমান্ত এলাকায় জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক অবস্থা মজবুত।

এদিকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় টিএসপি কারখানা থেকে এক হাজার ১৮২ টন রক সালফার পাচারের ঘটনায় আরো নতুন তথ্য মিলেছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। টিএসপি কারখানা থেকে চুরির পর তা আনা হয়েছিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ঝাউতলা আহলে হাদিস মসজিদে। সেখান থেকে কাঠের বাক্সে করে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। মসজিদ থেকে তা বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর নিকটাত্দীয়। একসময় তিনি 'রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন'-এর (আরএসও) সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে জামিনে ছাড়া পান। এখন দেশের বাইরে আছেন তিনি।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন