নিজস্ব প্রতিবেদক
মুক্তিযুদ্ধের সময় তুরাগ নদের তীরে আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যার মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। এ মামলার আসামি নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলীসহ অনেকে। অন্যদিকে পিরোজপুরে সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলাও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
পল্লবী গণহত্যা মামলা : মুক্তিযুদ্ধের সময় তুরাগ তীরের আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা করে কূপে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হয়। নিহতরা সবাই মুসলমান হলেও কারোরই দাফন-কাফন, জানাজা হয়নি।
আলোচিত গণহত্যার এই মামলাটির তদন্তভার সিআইডি থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু জানিয়েছেন, সিআইডির তদন্ত দল আসামিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এ কারণে তারা মামলাটির তদন্ত ভার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়েছে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে জানান, তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতকে এ বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। পরে আদালতের নির্দেশেই মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পল্লবীর আলোকদি গ্রামে গণহত্যার ঘটনার বর্ণনাকালে বাদী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া জবানবন্দিতে জামায়াত নেতাদের ভয়াবহ নৃশংসতা উঠে এসেছে। এর মধ্যে কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লাকে গণহত্যা মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ মামলায় নিজামীর রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। তাঁকে কারাগার থেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গণহত্যা মামলার আরেক আসামি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মীর কাসেম আলী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২৪ এপ্রিল ফজরের নামাজের সময় পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারযোগে তুরাগ নদের তীরে আলোকদি গ্রামের পশ্চিম দিকে নামে আর পূর্বদিক থেকে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে অসীম, আকতার, নেওয়াজ, লতিফ, ডোমাসহ প্রায় দেড় শ লোক গ্রামবাসীকে ঘিরে ফেলে। তারা নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও অন্যদিকে কাদের মোল্লাসহ জামায়াত বাহিনীর গুলিবর্ষণে ৬৪ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে গণহত্যা মামলার বাদী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন মোল্লার ২১ জন স্বজন ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটতে আসা ২৮০ জনকেও হত্যা করা হয়। নিহতরা কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন। গণহত্যা মামলার বাদী আমীর হোসেন মোল্লা তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, তাঁর আত্দীয় ২১ জন, গ্রামের ৪৩ জন ও কৃষিকাজে নিয়োজিত ২৮০ জনসহ ৩৪৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর মৃতদেহ তিনটি কূপে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
জবানবন্দিতে তাঁরা বলেছেন, মুসলমান হয়ে মুসলমানদের হত্যা করার পর মৃতদেহের গোসল, জানাজা, দাফন-কাফন না করে লাশগুলো কূপে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এসব কূপ থেকে গণহত্যার ৩৯ বছর পর আজও শহীদদের দেহাবশেষ উদ্ধার হচ্ছে। তাঁরা বলেছেন, এ ঘটনার সময় তাঁদের অনেকেই বিলের পানির কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে থেকে আত্দরক্ষা করেছেন।
জবানবন্দিতে তাঁরা বলেছেন, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, সরদার সালাম ও কাদের মোল্লার নেতৃত্বে সহস্রাধিক আলবদর, আলশামস, রাজাকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস ধরে আলোকদি গ্রাম ছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছে।
সাঈদীর দুই মামলা : পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। পিরোজপুরের প্রধান বিচারিক হাকিম (ভারপ্রাপ্ত) মাহাবুবুর রহমান গতকাল বুধবার দুপুরে এ আদেশ দেন।
পিরোজপুর সদর থানার ওসি শেখ মো. আবু জাহিদ জানান, জিয়ানগর থানা ও পিরোজপুর থানার পক্ষ থেকে মামলা দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর জন্য প্রধান বিচারিক হাকিমের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। আদালত গতকাল তা আমলে নিয়ে এ আদেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট সদর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সাইজদ্দিন পশারীর ছেলে মানিক পশারী হত্যা, অগি্নসংযোগ ও লুণ্ঠনের অভিযোগে সাঈদীসহ পাঁচজনকে আসামি করে পিরোজপুর সদর থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা সাঈদীর নেতৃত্বে পিরোজপুরের পাড়েরহাটের বাদুড়া নিবাসী ইব্রাহিম হাওলাদারকে গুলি করে হত্যা করে।
একাত্তরে হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ এনে জিয়ানগর থানায় সাঈদীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুর রহমান। এজাহারে বলা হয়, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বেণী মাধব শাহ, নাগরিক শাহ, তারক শাহ, রবি তালুকদার, জহর তালুকদার, হরেন ঠাকুরসহ অনেকের বাড়িতে আগুন দেয়। সংখ্যালঘু বহু পরিবারের সম্পদ লুট করে। দুজনকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন