10 July 2010

হিযবুত-জামায়াত গোপন বৈঠকের সমন্বয়ক ছিলেন কামারুজ্জামান

মাসুদ কার্জন

'জেএমবি বা হুজি জঙ্গি হলে হিযবুত তাহরীর হাইয়েস্ট ওর্ডার-এর জঙ্গি সংগঠন। হিযবুত তাহরীর ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে আসলে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, যা আছে তা হলো আবরণগত। সবার আলটিমেট গোল বা চূড়ান্ত লক্ষ্য সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা।' নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশের সিনিয়র উপদেষ্টা রিমান্ডে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম মাওলা জিজ্ঞাসাবাদে এ রকম মন্তব্যই করেছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে অধ্যাপক গোলাম মাওলা স্বীকার করেছেন, সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঐক্য গড়ে উঠেছিল। জামায়াতের আগ্রহেই এই ঐক্য হয়। সর্বশেষ ৩০ জুন জামায়াত নেতাদের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের গোপন যে বৈঠকে হয়, এর সমন্বয় করেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তবে বৈঠকে গোলাম মাওলা বা কামারুজ্জামান কেউই উপস্থিত ছিলেন না। তারা দুজনেই বৈঠকের খুঁটিনাটি সব কিছুই জানতেন। বৈঠকটির আলোচ্যসূচির মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে করণীয় বা সরকারকে অস্থিতিশীল। হিযবুতের লক্ষ্য সংগঠনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি বেগবান করা।

এদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গতকাল রমনা থানার ফারুক হোসেন হত্যা মামলায় চার দিনের রিমান্ড নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। আদালত আগেই এই মামলায় তাঁদের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। অপর দিকে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে পল্টন থানায় দায়েরকৃত তৃতীয় মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার মাহাবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য বা গোপন সম্পর্কের বিষয় নিশ্চিত হতে খুব তাড়াতাড়িই রিমান্ডে থাকা জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতার মুখোমুখি করা হবে গোলাম মাওলাকে। হিযবুতের 'থিং ট্যাংক' হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক গোলাম মাওলা শুধু দিকনির্দেশনা দিতেন। সরাসরি কোনো বৈঠক বা কর্মসূচিতে তিনি তেমন উপস্থিত থাকতেন না।

সূত্র জানায়, গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হিযবুত তাহরীর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় গোলাম মাওলার কাছে। তখন তাঁর মন্তব্য ছিল, এই সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা কখনো পটকা বা ককটেল ফাটাবে না। করলে তারা বিমান ছিনতাই করবে। তবে আপাতত সংগঠনের লোকবল বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছিল। ভালো অবস্থানে যাওয়ার আগে তাদের কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা একেবারেই নড়বড়ে।

নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলে গোলাম মাওলা বলেন, তাঁর শিক্ষাজীবনে কখনো দ্বিতীয় হওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। এসএসসি ও এইচএসসি দুটিতে স্ট্যান্ড করেছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স দুটিতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। পরে ১৯৮৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের ওপর পড়ালেখা করতে কমনওয়েলথের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। লন্ডনে জুলফিকার, ফিরোজ ও সালেহ নামে তিন প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর। তাদের মাধ্যমে এ সংগঠনের দীক্ষা নেন। পরে তারা কয়েকটি সেমিনার ও ধর্মীয় আলোচনা সভায় নিয়ে যায় তাঁকে। বিদেশি ধর্মতাত্তি্বকদের আধ্যাত্দিক আলোচনা শুনে তিনি তখন থেকেই খেলাফত রাষ্ট্র কায়েমের চিন্তা শুরু করেছিলেন। পরে ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরেই সংগঠন করার বিষয়টি নিয়ে ড. মহিউদ্দিন, মামুনুর রশীদ আনসারীসহ বিভিন্ন শিক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে ২০০১ সালে হিযবুত তাহরীর গঠন করেন। উত্তরায় ইসলামিক হেরিটেজ নামে একটি এনজিওর অফিসের একটি কক্ষ তাঁদের সংগঠনের জন্য দেওয়া হয়। ওই কক্ষে বসেই বৈঠক করতেন তাঁরা। লন্ডন থেকে টাকাও আসত ইসলামিক হেরিটেজের মাধ্যমে। তবে নিষিদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তৎপরতা গোপন করে ফেলেন।

যুক্তরাজ্যে পড়ালেখা করতে গিয়ে ওই দেশের মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। ঢাকায় ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুল পরিচালনা করেন। নিজের তিন সন্তানের সবাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে_তারপরও অন্যদের কেন ইসলামী শাসনের স্বপ্ন দেখান এ রকম প্রশ্ন করলে নীরব থাকেন গোলাম মাওলা।

সূত্রমতে, জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের সম্পর্ক জানতে চাইলে গোলাম মাওলা জানান, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অনেক পুরনো। হিযবুতের যাত্রা শুরুর পর জামায়াত-শিবির প্রথম তাঁদের সমর্থন দেয়। শুরুতে ঢাকার কাঁটাবন এলাকার একটি ভবনে গোপন পাঠচক্র করত হিযবুত তাহরীর। ওই জায়গাটি জামায়াতই তাদের দিয়েছিল। হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা আছে। ওই সব শিক্ষক জামায়াতের সঙ্গেও সম্পৃক্ত।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াতে ইসলামী নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই ছকের অংশ হিসেবেই বিভিন্ন ইস্যু তৈরি ও বিরোধী দলের ছত্রচ্ছায়ায় দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টার পরিকল্পনা করছিল। অজঙ্গি সংগঠনগুলো চাঙ্গা করতে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল জামায়াত। এ জন্য আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। প্রথম দফায় রাজশাহী, সিলেট ও চট্টগ্রামকে আন্দোলনের ক্ষেত্র বানোনোর চেষ্টা করছিল তারা। এর অংশ হিসেবে হিযবুত জামায়াত গোপন বৈঠক করে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, এ ব্যাপারে কিছু তথ্য তাঁদের কাছে আছে।

মুজাহিদ-সাঈদীর পছন্দ কারাগার : আদালত সূত্র জানায়, পল্টন থানার তিন মামলায় ৯ দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শনিবার বিকেলে মুজাহিদ ও সাঈদীকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের প্রথমে হাকিমের এজলাসে না তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পরে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মহানগর হাকিম আবদুল মজিদের এজলাসে তুলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তাঁদের আইনজীবী মশিউল আলম, আবদুর রাজ্জাক, এস এম কামাল উদ্দিন তাঁদের একটানা রিমান্ডের পর পরই আবারও রিমান্ডে না নিয়ে কারাগারে পাঠানোর আবেদন জানান। তাঁরা আদালতে বলেন, পল্টন থানার তিন মামলায় একটানা রিমান্ডের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা খুব ক্লান্ত এবং গুরুতর অসুস্থ। এ পর্যায়ে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হোক। কারাগারে সুস্থ হয়ে ওঠার পর এ মামলায় তাঁদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। আদালতের আগের আদেশ অনুযায়ী তাঁরা দুজনের সুচিকিৎসার আবেদন জানিয়ে বলেন, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করছেন।

এ আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর এম এ কামরুল হাসান খান আসলাম ও অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান লিখন বলেন, এ রিমান্ড আগেই মঞ্জুর হয়ে আছে। তাই ওই রিমান্ড বিষয়ে বক্তব্য রাখার তেমন কোনো সুযোগ নেই। তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়লে অবশ্যই তদন্ত কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেবেন। এ মুহূর্তে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুজাহিদ ও সাঈদী বলেন, তাঁরা ভীষণ অসুস্থ। তাঁদের কোনো প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। সাঈদী বলেন, রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। দুই পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন নাকচ করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। এরপর তাঁদের আইনজীবীরা পল্টন থানার তিন মামলায় মহানগর হাকিম মোস্তফা শাহরিয়ারের আদালতে তাঁদের জন্য জামিন চান। দুই পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তা নাকচ করে দেন।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন