3 July 2010

হরতালের আগের রাতে জ্বালাও-পোড়াও ছিল জামায়াতের অপকৌশল! জিজ্ঞাসাবাদকালে ভিডিও দেখে লজ্জায় পড়ে যান মুজাহিদ-সাঈদী

মাসুদ কার্জন

সরকারের সঙ্গে বিএনপিকে মুখোমুখি দাঁড় করাতেই হরতালের আগের রাতে গুপ্ত হামলা ও জ্বালাও-পোড়াও পন্থা বেছে নেয় জামায়াত। তাদের কৌশলটা ছিল এ রকম_সরকার বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে হার্ডলাইনে যাবে। বেকায়দায় পড়ে জামায়াতের কাছে আত্দসমর্পণ করবে বিএনপি। এতে বিএনপি-জামায়াতের টানাপড়েন কমে যাবে। এর মাধ্যমে যুগপৎভাবে সামনে এগোনো যাবে। এতে জামায়াতেরই লাভ হবে বেশি। এসব নানা দিক চিন্তা করে অনেকটা গায়ে পড়েই বিএনপির ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত। তবে তাদের সব কৌশলের মূলে যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো। কারণ, এই বিচার জামায়াত ও এর নেতাদের অস্তিত্বের বিষয়।

রিমান্ডে থাকা জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ রকম আভাস দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

ঢাকায় মিন্টো রোডের মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মাঝে একবার বিরতি দিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত এক দফা এবং পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে জুম্মার নামাজের আগ পর্যন্ত আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় জামায়াতের এই দুই শীর্ষ নেতাকে। পরে গোয়েন্দা কার্যালয়ের হাজতখানায় তাঁদেরকে জুম্মার নামাজ পড়তে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার আরেক নেতা জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী অসুস্থতার কথা বলায় গতকালও তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়নি।

পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করা, দেশে জঙ্গি তৎপরতা ছড়ানো, হরতালে অগি্নসংযোগ ইত্যাদি নানা বিষয়ে জামায়াত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে তাঁরা অনেক সময় কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত ছিল।

জিজ্ঞাসাবাদকারী একটি সূত্র জানায়, মুজাহিদ ও সাঈদীকে কখনো পৃথকভাবে আবার কখনো একসঙ্গে বসিয়ে অনেকটা আলাপ করার ছলে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মুজাহিদের চেয়ে সাঈদী কথা বলেন কম। মুজাহিদ একথা-ওকথা বলে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময় জিজ্ঞাসাবাদকারীদের নানা গল্প বা উপমা দিয়ে এটা-ওটা বোঝানোরও চেষ্টা করেন। ফলে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের আসল কথায় যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, 'দুজন এতটাই চালাক প্রকৃতির যে, কোনো কিছু বললে বা জানতে চাইলে বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের দল জামায়াতকে একটি ভালো দল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। এমন ভাব দেখানোর চেষ্টা করেন, যেন দেশের অভ্যন্তরে জামায়াত ও তাঁরাই একমাত্র সঠিক রাজনীতি করছেন। অন্যরা সব ভুল করছেন। অনেক সময় জামায়াতের গঠনতন্ত্র, দলের উদ্দেশ্য ইত্যাদি বোঝানোরও চেষ্টা করেন তাঁরা।

যুদ্ধাপরাধবিষয়ক কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে তাঁরা নিজেরাই এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। মাঝে মধ্যে বোঝানোরও চেষ্টা করেন, এসব করে কোনো লাভ হবে না। সরকার সফল হতে পারবে না। একপর্যায়ে তাঁরা মন্তব্য করেন, জামায়াতের দেশের বাইরে জানা-শোনা আছে। তবে কিভাবে জামায়াত এগোচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের দাবি_বিচার শুরু হলেই বাধাগুলো সরকার টের পাবে।

গতকাল শুক্রবার জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাঁদের কাছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের রাজধানীর পল্টনে ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার কারণ জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তাঁদের দুজনেরই দাবি_জামায়াত কোনো ভাঙচুর বা দেশবিরোধী কাজ করে না। এ সময় তাঁদের সামনে বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপিংস হাজির করা হয়। ভিডিও দেখিয়ে বলা হয়, এরা আপনাদের দলের নেতা-কর্মী। ভিডিওচিত্রে ঢাকা মহানগরের শীর্ষ এক জামায়াত নেতা দৌড়-ঝাঁপ করছেন, তাও তাঁদের দেখানো হয়। তখন দুজনেই বেশ লজ্জায় পড়ে যান।

জিজ্ঞাসাবাদকারী দল তখন তাঁদের বলে, 'প্রশ্ন করা হলে বুঝবেন, এর সপক্ষে কিছু না কিছু তথ্য-প্রমাণ হাতে রেখেই আপনাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে। তাই যেটা জানেন, সেটা বলে তদন্তে সহযোগিতা করবেন। আপনাদের কাছ থেকে অন্তত মিথ্যা কিছু আশা করি না।'

সব শেষে বিএনপির ডাকা গত ২৭ জুনের হরতাল প্রসঙ্গটি তোলা হয়। প্রথমে কিছু না বলতে চাইলেও হরতালে তাঁদের নেতা-কর্মীদের প্রতি মাঠে নামার কঠোর নির্দেশ ছিল বলে জানান তাঁরা। এ ছাড়া তাঁরা জানান, হরতালে কে কোন পয়েন্টে থাকবে, কার কী করণীয়_এসব মহানগর নেতারাই সমন্বয় করেন। তবে বড় কোনো সিদ্ধান্ত থাকলে অবশ্যই দলের হাইকমান্ডের অনুমতি নেওয়া হয়। মুজাহিদ ও সাঈদী বলেন, হরতাল সর্বাত্দক সফল হোক, সেটা জামায়াত-শিবিরের প্রত্যেক নেতা-কর্মী চেয়েছিল। ফলে কিছু অঘটন ঘটলেও ঘটতে পারে। হরতালের আগের রাতে তাঁদের কর্মীরা কিছু ঘটালেও ঘটাতে পারে। তবে গাড়িতে আগুনের ঘটনা সুনির্দিষ্ট কে করেছে, এ রকম কিছু তাঁদের জানা নেই।

জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তখন 'আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে, সরকার ও বিএনপিকে মুখোমুখি করিয়ে ফায়দা লোটার কৌশল হিসেবে আপনারাই হরতালের আগের রাতে জ্বালাও-পোড়াও করেছেন'_এ রকম বক্তব্য উপস্থাপন করলে দুই জামায়াত নেতা নীরব থাকেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় জামায়াতের এই দুই নেতা নিজেদের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও তাঁদের মানসিক জোর কম ছিল। হাজতখানায় রাখার পর কনস্টেবল বা সেন্ট্রিদের কাছ থেকে বাইরের খোঁজ-খবর জানার চেষ্টা করেন তাঁরা। কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে কি না, তাঁদের গ্রেপ্তারের পর বিএনপি কী বলছে ইত্যাদি বিষয় জানার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁরা কিছু না জানানোয় আরো হতাশ হচ্ছেন এই দুই নেতা।

সূত্র জানায়, সম্মানজনক আচরণ করেই তাঁদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের চেষ্টা চলছে। সুস্থবোধ করলে আজ-কালের মধ্যে নিজামীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হবে। গতকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর স্বজনরা দেখা করেছেন বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলার রিমান্ড আছে, সেগুলো ছাড়াও দেশে জঙ্গি তৎপরতা ও জঙ্গিদের উত্থান ইত্যাদি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জামায়াত নেতাদের। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবি প্রধান ও হবিগঞ্জ জেলা জামায়াতের সাবেক আমির সাইদুর রহমানের মুখোমুখি করা হতে পারে গ্রেপ্তার করা জামায়াত নেতাদের। এর আগে সাইদুর জঙ্গি ও জামায়াত সম্পর্কিত অনেক তথ্য দিয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক, আর্থিকভাবে জামায়াতের ভিত কিভাবে শক্তিশালী হলো, তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরের সম্পর্কিত নানা তথ্য জানার চেষ্টাও চলবে রিমান্ডে। মূলত জামায়াতের মধ্যে কার নির্দেশে শিবির চলে, সংগঠনটির আর্থিক দিক কে দেখে বা কিভাবে দেখভালো হয় ইত্যাদি বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলবে বলে সূত্র জানায়।

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন