25 May 2010

মীর কাসেমকে নিয়ে সন্দেহ, মুজাহিদের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন

সেলিম জাহিদ

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিচ্ছে। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী দেশে ফেরার পর তাঁর বিষয়ে দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের হঠাৎ সুর বদলে জামায়াত নেতাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধছে।

এদিকে দলীয় কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমিরদের সম্পৃক্ত না করে অবজ্ঞা করার অভিযোগ উঠেছে দলের একটি অংশ থেকে। অভিযোগ আছে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ দলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কৌশলে কাজ করছেন।

দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা বলেন, 'মীর কাসেম আলীকে নিয়ে এত হৈচৈ, এখন তিনি কোন কেরামতিতে তালিকা (সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী) থেকে বাদ পড়লেন, তা সাংবাদিকদের অনুসন্ধান করে বের করা উচিত।'

তবে মুজাহিদ দাবি করেন, 'শুধু মীর কাসেম আলী নন, জামায়াতের সব নেতা সম্পর্কে এমন কথাই বলতে হবে।'

মীর কাসেম দেশে ফেরার পরদিনই আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, মীর কাসেম আলী যুদ্ধাপরাধী নন।

এর আগে গত রোজায় মীর কাসেম আলীসহ জামায়াতে ইসলামীর তিন নির্বাহী পরিষদ সদস্যের উপস্থিতিতে রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের একটি অংশের গোপন বৈঠক নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল, এর রেশ এখনো কাটেনি।

ওই বৈঠকে সরকারের অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (এলপিআর) থাকা একজন সচিবের তৈরি একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। তাতে জামায়াতের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ৯টি কারণ উল্লেখ করে নামবদলসহ বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী কিন্তু মধ্যপন্থী, প্রয়োজনে বিএনপির সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতা-কর্মীদেরও দলে যোগদানের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। সম্প্রতি বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে।

মুজাহিদ এ ঘটনাকে 'হাওয়াই চেষ্টা' বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, 'নাম পরিবর্তন তো করেই ফেলেছি, আর কী পাল্টাব।' ওই চেষ্টা সেখানেই শেষ হয়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।

দলের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে বারবার আলোচনাকে দলে বিভাজন এবং নেতাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, জামায়াতের সিদ্ধান্ত 'কোনো থিংক ট্যাংক গ্রহণ করে না, জামায়াতের সিদ্ধান্ত নেতারা আলোচনা করেই গ্রহণ করেন।' পল্টনের ওই বৈঠকে কামারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়।

দলের বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মী ফারুক হোসেন হত্যার পর থেকে এ পর্যন্ত সব কর্মসূচিতে মুজাহিদ নিজেকে জামায়াতের 'ভোকাল' হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সরকারের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে তিনি কর্মী-সমর্থকদের কাছে নিজেকে দৃঢ়চেতা ও সাহসী নেতা প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব কর্মসূচিতে দলের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এড়িয়ে চলার কৌশল লক্ষ করেছেন তাঁরা।

অভিযোগ আছে, সেক্রেটারি জেনারেল এমনভাবে কর্মসূচি প্রণয়ন করছেন, যাতে তাঁর বলয়ের বাইরের নেতারা ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। বিশেষ করে দরাজ কণ্ঠের জন্য দলে ব্যাপক জনপ্রিয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কোণঠাসা করে রাখার কৌশল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের কাছেও সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

মুজাহিদ বলেন, 'কারো ব্যারাম হলে তা প্রকাশ পাবেই। আর প্রকাশ পেলে তা জামায়াতে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। হি উইল মাস্ট বি কনডেমড।'

ঢাকা মহানগর কর্মপরিষদের একজন নেতা জামায়াতের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'মাওলানা সাঈদী জামায়াতের কণ্ঠ, কিন্তু দল ওনাকে সদ্ব্যবহার করছে বলে মনে হচ্ছে না।'

সর্বশেষ ১০ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত 'সীমান্তে বিএসএফের বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে' অনুষ্ঠিত আলোচনায় দলের প্রটোকল ভেঙে মুজাহিদ প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান উপস্থিত থাকলেও তাঁকে দিয়ে মোনাজাত করানো হয়। দলের অনেক কর্মী তা ভালোভাবে নেননি।

নায়েবে আমিরদের অবজ্ঞা করার অভিযোগ অস্বীকার করে মুজাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জামায়াতের কর্মসূচি প্রণয়ন করে পলিটিক্যাল কমিটি, এ কমিটিতে তিনজন নায়েবে আমির আছেন। আর কর্মসূচি চূড়ান্ত করেন আমির।'

দলীয় সূত্রমতে, জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ঘিরে দলের অভ্যন্তরে নীরবে দুটি বলয় গড়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে দলের নীতিনির্ধারকরা নানাভাবে চেষ্টা চালালেও দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে একটি অংশ।

সম্প্রতি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিমকে নিয়ে সংগঠনের কার্যকরী পরিষদ সদস্যদের গণপদত্যাগের ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকরা ভেতরে ভেতরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। শিবিরে সংকট সৃষ্টির জন্য পদত্যাগীদের অনুসারীরা মুজাহিদকেই দায়ী করে গণমাধ্যমে তাঁর বার্তা পাঠান। শিবিরের সংকট নিরসনে গঠিত কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে সমাধানের উপায় খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়।
আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের সুপ্ত দ্বন্দ্ব দলের ঢাকা মহানগর কমিটিসহ অন্যান্য পর্যায়েও প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন ঘটনায় এর প্রকাশও ঘটেছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নগর জামায়াত আমির রফিকুল ইসলাম খানের মনোনয়ন নিয়ে এর প্রকাশ ঘটলেও তা চাপা দেওয়া হয়।

জামায়াতে ইসলামীর একটি অংশের অভিযোগ, ভবিষ্যতে দলের 'আমির' পদে নিজের অবস্থান সংহত করার লক্ষ্যে এখন থেকেই মুজাহিদ নানা কৌশলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে আমির পদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সাঈদীকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে মুজাহিদের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, 'জামায়াতে আমার আমির হওয়ার বাতাস নেই।'


খবরের লিংক

No comments:

Post a Comment

মন্তব্য করুন