নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ০১-০৪-২০১০
একাত্তরে কী করেছিলেন, তা মনে নেই জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের। তবে একাত্তরকে ‘অতীত’ বলে মনে করতে পেরেছেন তিনি। বলেছেন, ‘পাস্ট ইজ পাস্ট। পৃথিবীর কোনো দেশে অতীত নিয়ে এতটা ঘাঁটাঘাঁটি হয় না।’
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকার বড় মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অতীতের বিষয়ে এ কথা বলেন। অথচ গতকালই সার্বিয়া ১৯৯৫ সালে আট হাজার বসনীয় মুসলমান হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘একাত্তরে আপনার ভূমিকা কী ছিল?’। জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকেন যুদ্ধাপরাধ বলতে যা বোঝায়, সেই হত্যা, লুট, ধর্ষণ, কোনো কিছুতেই জড়িত ছিলাম না।...আপনি জেনে নেন, আমার এখন ৬২ বছর চলছে। এই হাত দিয়ে হত্যা করা তো দূরের কথা, কাউকে একটি চপেটাঘাতও দেইনি।’ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না—জানতে চাইলে মুজাহিদ বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না।’ এ পর্যায়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, একাত্তরের নয় মাস আপনি কী করেছেন, তা তো বলেননি। জবাবে তিনি বলেন, ‘বললামই তো...এত কিছু মনে নাই। ছাত্র ছিলাম, লেখাপড়া করছি। এটা লেখেন, মুজাহিদ সাহেব বলেছেন, একাত্তর সালে তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’
একাত্তরে জামায়াতের অবস্থান এখনো সমর্থন করেন কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখেন, পাস্ট ইজ পাস্ট (অতীত হচ্ছে অতীত)। অতীতের এসব নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি পৃথিবীর কোনো ইতিহাসে নাই।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। লিখিত বক্তব্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। তিনি দাবি করেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতাই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কাজেই তাঁদের তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো নৈতিক ও আইনগত সুযোগ নেই।’ তিনি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে কোনো জামায়াত নেতার বিচার হয়নি, কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা প্রাথমিক অভিযোগও দায়ের করা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে জামায়াতের বর্তমান জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসূফ ও জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের হত্যার ঘটনায় জামায়াতের নেতা খালেক মজুমদারেরও একই সাজা হয়েছিল। এ তথ্য জানিয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে মুজাহিদ বলেন, ‘প্রথম দুইজনের সাজা হয়েছিল, কারণ তাঁরা মালেক মন্ত্রিসভার (মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত মন্ত্রিসভা) সদস্য ছিলেন। তবে হ্যাঁ, আপনি খালেক মজুমদারের কথা বলতে পারেন। তিনি জামায়াতের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন না, এখনো নেই। নিম্ন আদালত তাঁকে সাজা দিলেও উচ্চ আদালত তাঁকে বেকসুর খালাস দিয়েছিল।’
লিখিত বক্তব্যে মুজাহিদ দাবি করেন, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী তত্কালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়েছিল এবং এতে জামায়াতের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
‘রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনীতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আপনাদের লেখা বিভিন্ন চিঠি এখন উদ্ধার হচ্ছে’—সাংবাদিকদের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুজাহিদ দাবি করেন, ‘এগুলো সবই নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের নাজেহাল করার জন্য এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
‘মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পশ্চিম পাকিস্তানে যে প্রতিবেদন পাঠাত, তাতে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও আপনার বিষয়ে উল্লেখ আছে। আপনারা আলবদর বাহিনী গঠনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করতেন বলে উল্লেখ আছে। জামায়াতের বর্তমান কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই নিজ নিজ এলাকায় এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে’—সাংবাদিকদের এমন তথ্যের বিপরীতে মুজাহিদ বলেন, ‘এসব ডাহা মিথ্যা কথা, অসত্য এবং বানোয়াট।’
জামায়াতের নায়েবে আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসূফ ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী সড়কে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ সে সময়কার প্রতিটি সংবাদপত্রে ওই খবর ছাপা হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মুজাহিদ এই প্রতিবেদনকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘সংগ্রাম বা কোনো পত্রিকাকে দলিল বানাতে চাই না। রিপোর্টার রিপোর্ট তৈরি করে।...সে সময়ের সংগ্রামের দায়-দায়িত্ব আমরা নিতে পারি না।’
লিখিত বক্তব্যে মুজাহিদ বলেন, আজ জামায়াতের যেসব নেতাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তাঁরা কেউই স্বাধীনতার পর পালিয়ে ছিলেন না। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের আগে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযমের দেশ থেকে চলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘গোলাম আযম ১৬ ডিসেম্বরের আগে সাংগঠনিক সফরে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ফ্লাইট ঢাকায় আসেনি।’
একাত্তরে জামায়াত ও তার তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, ‘তখন ছাত্রসংগঠন যেটা ছিল (জামায়াতের) সেটা পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছিল। তবে কোনো অপকর্মের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল না।’ নিজেদের দেশপ্রেমিক বলেও দাবি করেন মুজাহিদ।
একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের এখন দেশপ্রেমিক বলা যাবে কি না—জানতে চাইলে মুজাহিদ বলেন, ‘অবশ্যই। আপনার এ ধরনের মনোভাব নেতিবাচক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াত জীবন দিয়ে, জান দিয়ে কাজ করেছে।... বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমরা এর জন্য জীবন দেব।’
১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বদর দিবসে বায়তুল মোকাররমের জনসভায় মুজাহিদ সভাপতিত্ব করেন। পরদিন দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছবিসহ এই সংবাদ ছাপা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুজাহিদ বলেন, ‘এটা পত্রিকার বানানো কথা। বাস্তব কথা না।’
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন