সেলিম জাহিদ
ছাত্রশিবিরকে নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কার্যত বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ঘিরে দলটির অভ্যন্তরে দুইটি ধারা তৈরি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চেপে রাখতে দলটির নীতিনির্ধারকরা ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তা যেকোনো সময় প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে।
গত সোমবার মধ্যরাতে শিবিরের কার্যকরী পরিষদের গণপদত্যাগের খবরে জামায়াতের নীতিনির্ধারক বিচলিত হয়ে পড়েন। গতকাল মঙ্গলবার দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও এ সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে সমাধানের উপায় খোঁজে। তবে এ ঘটনায় জামায়াতে বিভক্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে মুজাহিদ এ প্রতিবেদককে বলেন, '...আরে ধুত, জামায়াত একটি ওয়েল রেজিমেন্টেড অর্গানাইজেশন (সুসংগঠিত ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন), জামায়াতে এসব নেই।'
দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ভাষায়, 'এ ঘটনায় জামায়াতের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে ঘটনাটি দুঃখজনক।'
নির্ভরযোগ্য সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, এই বিভক্তি জামায়াত ও শিবিরের মধ্যেও বড়সড় দূরত্ব তৈরি করেছে। ছাত্রশিবিরের একটি অংশ সম্প্রতি জামায়াতের চলমান আন্দোলনে না জড়ানোরও ইঙ্গিত দিয়েছে। এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচি না দেওয়ার জন্য তাদের পক্ষ থেকে অনুরোধও করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদত্যাগী একজন শিবির নেতা বলেন, 'আমরা এখনই কোনো আন্দোলনে যেতে রাজি নই। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে আমরা বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি।'
প্রাপ্ত তথ্যমতে, নেতৃত্ব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের ভেতরে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে, এর নেপথ্যে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে শিবিরের ক্ষুব্ধ একটি অংশ 'সেভ শিবির' শিরোনামে একাধিক ই-মেইল বার্তায় শিবিরের সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নৈতিকতাবিরোধী কিছু কর্মকাণ্ডসহ জামায়াত সেক্রেটারি মুজাহিদ ও শিবিরের সাবেক দুই সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান (ঢাকা মহানগর আমির) ও নুরুল ইসলাম বুলবুলকেও (সহকারী সেক্রেটারি) দায়ী করে আসছে।
জানতে চাইলে মুজাহিদ বলেন, 'যারা এ ঘটনায় আমাকে জড়াচ্ছে, তারা আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলে অনুমান এবং আন্দাজ করে বলছে।'
এ ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরীসহ ২৬ জন কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে ডা. মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সংবিধান অনুযায়ী দল পরিচালনায় আমি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। মনে করেছি ব্যর্থ নেতৃত্ব না দেওয়াই শ্রেয়।'
'৮২-র পুনরাবৃত্তি?
১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রশিবিরে প্রথম ভাঙন দেখা দিয়েছিল ১৯৮২ সালে। তখনো জামায়াতের হস্তক্ষেপ মানতে না পেরে শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আহমদ আবদুল কাদের ও সেক্রেটারি ফরিদ আহমদসহ কার্যকরী পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য শিবির ত্যাগ করেন। পরে আহমদ আবদুল কাদের ১৯৮২ সালের ২৮ আগস্ট 'যুবশিবির' গঠন করেন। বর্তমানে তিনি খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মহাসচিব।
আহমদ আবদুল কাদের গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, '২৫ বছর আগের বিষয় নিয়ে কথা বলে তিক্ততা সৃষ্টি করতে চাই না। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা, অনেক লেখালেখি হয়েছে।'
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে ১৯৮২ সালের বিদ্রোহী ওই ছাত্রনেতা বলেন, 'ওই সময় আমরা কারো নিয়ন্ত্রণ চাইনি, স্বাধীনতা চেয়েছি। এখনো বলব, ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে, এটা কেবল মুখে বললেই হবে না।'
ওই সময়কার শিবিরের কাপ সদস্য বিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসক ডা. মো. আবদুল্লাহ খান এ প্রতিবেদককে বলেন, 'জামায়াত বারবার একই ভুল কেন করছে, তা আমার মাথায় আসে না।'
মুজাহিদের লক্ষ্য
এদিকে জামায়াতের একটি অংশের অভিযোগ, আগামী মেয়াদে দলের 'আমির' পদে নিজের অবস্থান নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে এখন থেকেই আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ নানা কৌশলে চেষ্টা চালাচ্ছেন।
জামায়াতের প্রথম সারির একজন নেতা জানান, নিজামীর পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সম্ভাব্য আমির মনে করছেন দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তিনি জামায়াত ও শিবির_উভয় অংশেই জনপ্রিয়। ওই নেতার মতে, মুজাহিদ এ বাধা টপকাতে সম্প্রতি কৌশলে সাঈদীর সঙ্গে আত্দীয়তার বন্ধন গড়েছেন।
এ বিষয়ে মুজাহিদ বলেন, 'আমরা নেতৃত্বের জন্য রাজনীতি করি না, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাজনীতি করি। আর যিনি আমির আছেন, আমি তাঁর নেতৃত্বে সন্তুষ্ট। আমি তাঁকে একজন যোগ্য নেতা মনে করি।'
ঢাকা মহানগরেও বিভক্তি!
একই বিভক্তি ঢাকা মহানগর কমিটিতেও। নগর আমির রফিকুল ইসলাম খান কেন্দ্রীয় আমির মতিউর রহমান নিজামীর এবং সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ এমপি মুজাহিদের বলয়ে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এর প্রকাশ ঘটলেও তা চাপা দেওয়া হয়। রফিকুল ইসলাম খান কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ওই সময়কার এক বৈঠকে তাঁর মনোনয়নে ভূমিকা না রাখার জন্য সরাসরি মুজাহিদকে দায়ী করেন। এ নিয়ে মুজাহিদ ও রফিকুল খানের মধ্যে উত্তপ্ত বিতণ্ডা হয়। পরে নীতিনির্ধারকদের একাংশের সিদ্ধান্তে রফিকুল খান সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে জোটপ্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হন।
বিভক্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তাই নাকি! এসব কথা কারা বলে।
শিবিরের বর্তমান অবস্থা
ছাত্রশিবিরের ৪৮/১-এ পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ফটকে গতকাল মঙ্গলবার দিনভর তালাবদ্ধ রেখে ভেতরে নিরাপত্তা প্রহরী বসিয়ে রাখা হয়। দলের নেতা ছাড়া ওই ভবনে অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না।
বিকেলে শিবিরের কেন্দ্রীয় স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক আতিকুর রহমান সরকার বলেন, 'শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ (কাপ) সদস্য নির্বাচন চলছে। সামগ্রিক বিষয়ে আমরা বক্তব্য দেব।'
জানা গেছে, গত রবিবার থেকে কার্যকরী পরিষদের ভোটগ্রহণ চলছে। গতকাল ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। জামায়াতের সেক্রেটারি নির্বাচনের উল্লেখ করে বলেন, এটি শেষ হলে দু-এক দিনের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির (সেক্রেটারিয়েট) সদস্য সংখ্যা ২১ এবং কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য ৪১ জন। পদাধিকার বলে শিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারি পরিষদের সদস্য। এর মধ্যে গত সোমবার ২৬ জন পদত্যাগ করেন। শিবিরের প্রান্তিক সদস্যরা গোপন ভোটে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচন করেন।
বর্তমানে প্রতি ১২৫ সদস্যের অনুকূলে একজন কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ হিসাবে সারা দেশে শিবিরের সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৬৭৫।
১৭ জনের পদত্যাগ
শিবিরের কেন্দ্রীয় পরিষদ থেকে একযোগে ২৬ জনের পদত্যাগের কথা বলা হলেও ১৭ জনের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। পদত্যাগী নেতারাও প্রতিবেদককে ২৬ জনের নাম বলতে পারেননি।
এর মধ্যে কেবল শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। বাকিরা পদত্যাগের নিয়ম অনুসরণ করেননি। সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে যাঁরা পদত্যাগ করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক আহমদ জাহিদুল আনোয়ার, শিক্ষা সম্পাদক যোবায়ের আহমদ ভূঁইয়া, অর্থ সম্পাদক আবদুল জাব্বার খান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক শাহ মো. ফয়সাল, প্রচার সম্পাদক গোলাম মাওলা শিমুল, ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক আহমদ শিহাবুল্লাহ, তথ্য সম্পাদক আসাদ উদ্দিন, পাঠাগার সম্পাদক আবুল কালাম আযাদ, সমাজকল্যাণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন, কার্যকরী পরিষদের সদস্য আবু নাছের, তারেকুজ্জামান, নুরুল ইসলাম আকন, শাহরিয়ার আলম, নাছির আহমেদ ও শহিদুল্লাহ শরীফ।
জামায়াত নেতাদের প্রতিক্রিয়া
ছাত্রশিবিরের নেতাদের গণপদত্যাগের খবর মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারকে সন্দেহের চোখে দেখছেন জামায়াতের সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'ছোট্ট একটি বিষয়কে মিডিয়াগুলো এত বড় করে কেন দেখছে, তা আমি বোঝার চেষ্টা করছি।'
এ বিষয়ে জানতে সোমবার দিবাগত রাত ১টায় ফোন করলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, 'শিবিরের সেক্রেটারি পদত্যাগ করেছে বলে জানি। কিন্তু কার্যকরী পরিষদের সদস্যদের কথা জানি না।' বিষয়টি নিশ্চিত করার পর তিনি বলেন, 'যারা পদত্যাগ করেছে, তাদের ছাত্রজীবন শেষ। তবে তারা এভাবে পদত্যাগ না করলেও পারত।'
এ বিষয়ে শিবিরের পদত্যাগী সেক্রেটারি বলেন, এটা ভুল তথ্য। কার ছাত্রত্ব শেষ হবে, তা কার্যকরী পরিষদই ঠিক করে। পরিষদ কাউকে প্রয়োজন মনে করলে মাস্টার্স পাসের পরও উচ্চতর শিক্ষায় রেখে সংগঠনে রাখতে পারে।
মঙ্গলবার দুপুরে ফোন করলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মকবুল আহমদ পদত্যাগীদের ইঙ্গিত করে বলেন, যাওয়ার আগে একটু দেখিয়ে গেল আর কি।
তদন্ত কমিটির দীর্ঘসূত্রতা
অভিযোগের তদন্তে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে। তবে এ মাসেই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদ শৃঙ্খলার স্বার্থে শিবিরের সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিমকে 'পারিবারিক কারণ' দেখিয়ে পদত্যাগের সুপারিশ করেছিলেন। এ সুপারিশে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ দলের নির্বাহী পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য একমতও হয়েছিলেন বলে ওই সূত্রের দাবি। কিন্তু আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তাতে বাদ সাধেন।
জানা গেছে, তদন্ত কমিটি শিবিরের সভাপতি রেজাউল করিমকে সাক্ষ্য দিতে হাজির হতেও বলেছিল। কিন্তু প্রভাবশালী এক নেতার প্রশ্রয়ে রেজাউল কমিটির ডাকে সাড়া দেননি। এতে জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা ক্ষুব্ধ ও হতবাক হন।
এ বিষয়ে গত রাতে রেজাউল করিম বলেন, 'আমাকে কেউ ডাকেনি, আমি যাইওনি।' তাঁর মতে, এটি কোনো তদন্ত কমিটি নয়। গোটা দেশে ছাত্রশিবিরে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তা কেন এবং কোথায় এর উৎপত্তি, তা উদ্ঘাটনে কমিটি হয়েছে। তিনি বলেন, 'কমিটির প্রতিবেদন জমা দিতে সময় লাগবে। কারণ তারা সবে কেন্দ্রীয় পরিষদের ২৫-২৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে। এখনো জেলা সভাপতিদের বক্তব্য নেয়নি। আর আমি তো সবার শেষে সাক্ষ্য দেব।'
খবরের লিংক
No comments:
Post a Comment
মন্তব্য করুন